সারা দেশে গত পাঁচ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৩ হাজার ২৫৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও ৫০ হাজার ৮৮৭ জন। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩৫ শতাংশ, আর রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে মারা গেছেন ২৩ শতাংশ মানুষ। নিহতদের ৪২ শতাংশের বেশি নারী, শিশু ও শিক্ষার্থী।
২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশের সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের করা এক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে ৪ হাজার ৬৩৫টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫ হাজার ৪৩১ জন, আহত হয়েছেন আরও ৭ হাজার ৩৭৯ জন। ২০২১ সালে ৫ হাজার ২৭১টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন, আহত আরও ৭ হাজার ৪৬৮ জন। ২০২২ সালে ৬ হাজার ৮২৯টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৭ হাজার ৭২৩ জন, আহত ১২ হাজার ৬১৫ জন। ২০২৩ সালে ৭ হাজার ১৩টি দুর্ঘটনায় নিহত ৬ হাজার ৫২৪ জন, আহত ১১ হাজার ৪০৭ জন। ২০২৪ সালে ৭ হাজার ২৭টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭ হাজার ২৯৪ জন, আহত হয়েছেন ১২ হাজার ১৮ জন।
যানবাহনভিত্তিক মৃত্যু: শীর্ষে মোটরসাইকেল
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের বিশ্লেষণ বলছে, সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১১ হাজার ৮৬৪ জন, যা মোট মৃত্যুর ৩৫.৬৭ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পথচারী, গত পাঁচ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৬৫৯ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট মৃত্যুর ২৩.০৩ শতাংশ। এরপরে রয়েছে থ্রি-হুইলারচালক ও যাত্রী নিহত ৫ হাজার ৬৫৭ মানুষ, যা মোট মৃত্যুর ১৭ শতাংশ। এছাড়াও নিহতদের মধ্যে ভারী যানবাহনের যাত্রী ৬.৭২ শতাংশ, বাসযাত্রী ৫.১৭ শতাংশ, স্থানীয় যানবাহন ৫.৫৫ শতাংশ, প্রাইভেটকার/মাইক্রোবাস/অ্যাম্বুলেন্স ৪.২৪ শতাংশ এবং বাইসাইকেল ও রিকশা ২.৫৮ শতাংশ।
নারী-শিশু ও শিক্ষার্থী মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক
গত পাঁচ বছরের সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৩ হাজার ২৫৬ জন নিহতের মধ্যে নারী, শিশু ও শিক্ষার্থী রয়েছে ১৪ হাজার ২১৬ জন, যা মোট মৃত্যুর ৪২ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর মধ্যে শিশু নিহত হয়েছে ৪ হাজার ৮০৬ জন (১৪.৪৫%), নারী নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৭২৬ জন (১৪.২১%) এবং শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে ৪ হাজার ৬৮৪ জন (১৪.০৮%)।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিশুদের বেশিরভাগ দুর্ঘটনা স্কুলে যাওয়া বা খেলার সময় ঘটে। নারী ও শিক্ষার্থীরা মূলত পথচারী বা যাত্রী হিসেবেই প্রাণ হারিয়েছেন।
পথচারীর মৃত্যু
পাঁচ বছরে সড়ক পারাপারে কিংবা ফুটপাতে ৭ হাজার ৬৫৯ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট মৃত্যুর ২৩ দশমিক ০৩ শতাংশ। তাদের মধ্যে ৫৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ রাস্তা পার হওয়ার সময় এবং ৪৫ দশমিক ৫২ শতাংশ রাস্তায় হাঁটার সময় দুর্ঘটনায় পড়ে মারা গেছেন।
সবচেয়ে বেশি পথচারী মারা গেছেন আঞ্চলিক সড়কে ৩৪.৪৫ শতাংশ এবং জাতীয় মহাসড়কে তার পরিমাণ ২৬.৬৭ শতাংশ।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা
পাঁচ বছরে ১১ হাজার ৭২৫টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১১ হাজার ৮৬৪ জন, যা মোট দুর্ঘটনার ৩৮ দশমিক ০৯ শতাংশ এবং মোট মৃত্যুর ৩৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে—কিশোর চালকদের বেপরোয়া আচরণ, অদক্ষ ও অসুস্থ ড্রাইভিং, ট্রাক ও বাসের সঙ্গে সংঘর্ষ এবং ট্রাফিক আইনের দুর্বল প্রয়োগ।
দুর্ঘটনায় জড়িত যানবাহন
গত পাঁচ বছরে ৫৬ হাজার ৩৫১টি যানবাহন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ভারী পণ্যবাহী যানবাহন (ট্রাক, কভার্ডভ্যান, পিকআপ) ২৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ, মোটরসাইকেল ২২ দশমিক ১৭ শতাংশ, থ্রি-হুইলার ১৮ দশমিক ৪০ শতাংশ, বাস ১২ দশমিক ৩৯ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ১২ দশমিক ০৩ শতাংশ।
দুর্ঘটনার ধরন
গত পাঁচ বছরে মোট ৩০ হাজার ৭৭৫টি দুর্ঘটনার মধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সংঘর্ষ ৩৯ দশমিক ০৪ শতাংশ, পথচারীকে ধাক্কা ২৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ, মুখোমুখি সংঘর্ষ ২০ দশমিক ৫৩ শতাংশ, পেছন থেকে ধাক্কা ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সড়ক অবকাঠামো উন্নত হলেও অতিরিক্ত গতি ও বেপরোয়া চালনা এই দুর্ঘটনার মূল কারণ।
কোন রাস্তায় বেশি দুর্ঘটনা
প্রতিবেদন অনুযায়ী, আঞ্চলিক সড়কেই সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার পরিমাণ প্রায় ৩৭ দশমিক ০৫ শতাংশ, জাতীয় মহাসড়কে দুর্ঘটনা ৩৫ দশমিক ২৫ শতাংশ, গ্রামীণ সড়কে ১৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ, শহুরের সড়কে ১১ দশমিক ২৪ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
সময়ভিত্তিক বিশ্লেষণ
সকালে (অফিস বা স্কুলের ব্যস্ত সময়) সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। ২৯ দশমিক ৪১ শতাংশ দুর্ঘটনায়ই ঘটেছে সকালে, বিকাল ১৯ দশমিক ২২ শতাংশ, রাতে ১৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ, দুপুর ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ, সন্ধ্যায় ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং ভোরে ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
গার্মেন্টস শ্রমিক ও পেশাজীবী নিহত
গত পাঁচ বছরে ৪৬৭ জন গার্মেন্টস শ্রমিক এবং ৫ হাজার ৫৫ জন পরিবহন শ্রমিক ও ড্রাইভার সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সকালে কর্মস্থলে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার হার সবচেয়ে বেশি। শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, সড়ক ব্যবস্থাপনার বিশৃঙ্খলা এবং নিরাপদ পারাপারের অভাবকে এর মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রাণহানি
২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৩৭৬ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে পুলিশ সদস্যই ২৬৬ জন।
রাজধানীতে দুর্ঘটনা
গত পাঁচ বছরে রাজধানীতে ১ হাজার ২২৮টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৩৩ জন, আহত হয়েছেন আরও ১ হাজার ৪৮৯ জন। নিহতের মধ্যে ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ পথচারী, ৩৮ দশমিক ৬ শতাংশ মোটরসাইকেলচালক এবং ১৯ শতাংশ বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রী। শহরে রাত ও ভোরে দুর্ঘটনা বেশি দুর্ঘটনা ঘটে, কারণ ভারী যানবাহনগুলো তখন শহরের রাস্তায় বেপরোয়া চলে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে সড়ক অবকাঠামো উন্নত হলেও নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থাপনা, চালকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, ট্রাফিক আইন প্রয়োগ এবং সচেতনতা কার্যক্রমে ঘাটতি থাকায় দুর্ঘটনার হার কমছে না।
এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এখনও সমন্বিত সড়ক পরিবহন কৌশল (ইন্টিগ্রেটেড ট্রান্সপোর্ট স্ট্রাটেজি) গড়ে ওঠেনি। এই কৌশল না থাকায় সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। পরিবহন নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই—একেকটি সংস্থা একেক নিয়মে কাজ করে। ফলে তৈরি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম ও জবাবদিহির অভাব। যার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবছরই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।’
আইনের শাসনের ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এত দুর্ঘটনার পরও বিআরটিএ, ডিপিসি বা সিটি করপোরেশনের কারও কোনও শাস্তি হয়নি। এই আইনের শাসনের অনুপস্থিতি ও প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধের বড় বাধা।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই সমস্যা থেকে বের হতে হলে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি গণপরিবহনকে আধুনিক ও নিরাপদ করতে হবে। গণপরিবহন উন্নত হলে মোটরসাইকেল, অটোরিকশা ও অন্যান্য ছোট যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।’
তিনি সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকার বারবার শুধু কমিটি গঠন ও সুপারিশ তৈরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। এতে কোনও কার্যকর ফল আসছে না। নীতিনির্ধারকরা নিজেরা গণপরিবহন ব্যবহার না করায় সাধারণ মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করতে পারেন না। তাই সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার বাস্তব উদ্যোগ এখনও দেখা যাচ্ছে না।’
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা কখনোই এমনি এমনি ঘটে না। এর পেছনে একাধিক কারিগরি ব্যর্থতা (টেকনিক্যাল ফেইলুর) জড়িত থাকে—যেমন যানবাহনের ত্রুটি, রাস্তার নকশাগত সমস্যা, আইন প্রয়োগের ঘাটতি, এমনকি পথচারী ও চালকদের অজ্ঞতা বা অসচেতনতা। এই বিষয়গুলোই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। কিন্তু আমাদের দেশে এসব কারিগরি ত্রুটি সমাধানের পরিবর্তে আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা হয়। ফলে সমস্যার মূল জায়গায় ওষুধ প্রয়োগ না হয়ে উপসর্গ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখনই সময় সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রকৌশলভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার। আমাদের প্রতিটি পর্যায়ে কারিগরি দৃষ্টিকোণ থেকে পরিকল্পনা নিতে হবে—রাস্তা নির্মাণ, যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ, সিগন্যাল ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগ—সব জায়গায় প্রযুক্তিনির্ভর ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। কেবল নিয়ম তৈরি নয়, তার সঠিক বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণই দুর্ঘটনা কমাতে সহায়তা করবে।’
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইস এম শাহাদাত হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা রোধে একাধিক সংস্থা একসঙ্গে কাজ করছে, আর পুলিশ তার মধ্যে অন্যতম স্টেকহোল্ডার। আমরা মূলত ট্রাফিক আইন প্রয়োগ ও সচেতনতা বৃদ্ধি— এই দুই ক্ষেত্রেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। চালক ও পথচারীদের আইন মানতে উৎসাহিত করতে নিয়মিত তদারকি ও সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সড়ক নিরাপত্তা একটি সমন্বিত বিষয়। তাই শুধু পুলিশ নয়, স্থানীয় সরকার, রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে বিভাগ, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটিসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সঙ্গে সমন্বিত কর্মসূচি পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকায় এখন এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় আরও জোরদার করা হচ্ছে, যাতে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ফলাফল নিশ্চিত করা যায়।’