জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন বাস্তবতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এখন কোনো ছাত্র সংগঠনের একক আধিপত্য নেই। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের জন্য হলগুলোর আসন বণ্টনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেকটা। এমন প্রেক্ষাপটে দীর্ঘ ৬ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন আজ। ভোটগ্রহণ হবে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। ভোটকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মাঝে দেখা গেছে উৎসবের আমেজ। এবারের ডাকসু ভোটে আংশিক ও পূর্ণাঙ্গ মিলিয়ে অন্তত ৯টি প্যানেল অংশ নিচ্ছে। এর বাইরে স্বতন্ত্র হিসাবে লড়ছেন প্রার্থীদের আরেকটি অংশ। নির্বাচনে এবার অনেকটা ভিন্ন পরিস্থিতি। কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না শীর্ষ তিন পদে কে জয়ী হবেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে ডাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস)সহ অধিকাংশ পদে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। তবে সবার নজর ভিপি ও জিএস পদের দিকে। ভিপি পদে ছাত্রদল মনোনীত আবিদুল ইসলাম খান ও ছাত্রশিবির সমর্থিত আবু সাদিক কায়েমের মধ্যে মূল লড়াই হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ পদে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্যের উমামা ফাতেমা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন ও বাগছাসের আব্দুল কাদেরও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারে। আর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ছাত্রদল মনোনীত শেখ তানভীর বারী হামীমের সঙ্গে মূল লড়াই হতে পারে ছাত্রশিবির সমর্থিত এসএম ফরহাদের সঙ্গে। তবে বাগছাসের আবু বাকের মজুমদারও আলোচনায় রয়েছেন। সেক্ষেত্রে এ পদে লড়াই হতে পারে ত্রিমুখী। আবার ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসুও চমক দেখাতে পারে। এজিএস পদেও তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার ঢাবি ক্যাম্পাসে সারাদিন সরেজমিন ঘুরে এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
এদিকে নির্বাচন উপলক্ষ্যে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনকে ঘিরে পুরো ক্যাম্পাস নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে। ৮টি প্রবেশপথে পুলিশ, প্রক্টরিয়াল টিম, বিএনসিসির সদস্য ও সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করছেন। এছাড়া ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ক্যাম্পাসের ভেতরে ভ্রাম্যমাণ দোকান সোমবার থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সোমবার রাত ৮টার পর বৈধ পাশধারী ছাড়া কাউকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। নির্বাচনে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। সোমবার ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শনে গিয়ে টিএসসিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিসি মোল্লা আজাদ। তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশেষ নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়া অন্য কেউ তাদের বৈধ বা লাইসেন্সধারী অস্ত্র বহন করতে পারবেন না। এই সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাসে অস্ত্র বহন করা হলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে।
ঢাবি উপাচার্য : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, ‘এবারের নির্বাচন বিভিন্ন কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, ঐতিহাসিক। সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য সব রকম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। স্বচ্ছতাই আমাদের প্রধান শক্তি। সিসিটিভিসহ ৩ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। নির্বাচনি কর্মকর্তারা নিরপেক্ষ। যারা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে রয়েছেন, সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখছেন। আমরা এলইডি স্ক্রিনের মাধ্যমে ভোট গণনা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেব।’
শিক্ষার্থীদের নির্ভয়ে ভোট দিতে আসার আহ্বান জানিয়ে উপাচার্য নিয়াজ আহমদ খান বলেন, ‘তোমরা নির্ভয়ে ভোট দিতে আসবে, আমরা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছি।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু নির্বাচন প্রক্রিয়া; কিছু প্রার্থী জিতবেন, কিছু প্রার্থী জিতবেন না। জয়-পরাজয় থাকবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিজয়ী ও পরাজিত উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।’
যত প্রার্থী ও ভোটার : ডাকসুতে এবার মোট ভোটার ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন। এর মধ্যে ছাত্র ২০ হাজার ৯১৫ ও ছাত্রী ১৮ হাজার ৯৫৯ জন। ডাকসুতে ২৮টি পদের বিপরীতে ৪৭১ প্রার্থী। সহসভাপতি (ভিপি) পদে ৪৫ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ১৯ জন ও সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে ২৫ জন প্রার্থী। ১৮টি হলে ১৩টি পদে ১ হাজার ৩৫ প্রার্থী। আছে ৯টি প্যানেল-ছাত্রদল, ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’, বাগছাস সমর্থিত ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’, বাম সংগঠনের (একাংশ) ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’, সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য, ছাত্র অধিকার পরিষদের ডাকসু ফর চেঞ্জ, তিন বাম সংগঠনের ‘অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪ ও ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ। একজন ভোট দেবেন ৪১টি করে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদে ২৮টি, হল সংসদে ১৩টি পদে।
৮ কেন্দ্রে ৮১০ বুথে ভোট, গণনা সরাসরি দেখানো হবে এলইডি স্ক্রিনে : এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের জন্য ৮ কেন্দ্রে ৮১০টি বুথ প্রস্তুত করা হয়েছে। নির্বাচনকে স্বচ্ছ করতে ভোটগ্রহণের আগে খালি বাক্স সিলগালা করা হবে সংবাদমাধ্যমকর্মীদের সামনে। পরে কেন্দ্রের সামনে ভোট গণনা ‘সরাসরি’ দেখানো হবে এলইডি স্ক্রিনে। সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ব্যালট বাক্স প্রদর্শন করে সিলগালা করা হবে। ভোটারদের ব্যাগ, মোবাইল ফোন, স্মার্ট ওয়াচ, যে কোনো ধরনের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, পানির বোতল ও তরল জাতীয় কোনো পদার্থ নিয়ে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করা যাবে না।
সবার নজর ভিপি-জিএস পদ : ভিপি পদে লড়ছেন ৪৫ জন প্রার্থী। প্রায় প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব ফোরাম। তবে এই পদে ভোটের লড়াইয়ে আছেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের আবিদুল ইসলাম, ছাত্রশিবির সমর্থিত সাদিক কায়েম ও স্বতন্ত্র প্যানেলের উমামা ফাতেমা, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ-বাগছাস সমর্থিত আব্দুল কাদের, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ সমর্থিত বিন ইয়ামিন মোল্লা ও স্বতন্ত্রে শামীম হোসেন। আবিদুল ইসলাম শিক্ষার্থীদের কাছে বেশ পরিচিত মুখ। এই প্রার্থী ক্যাম্পাসের বাইরে থাকেন (অনাবাসিক ৪০ শতাংশের বেশি) এমন ভোটারদের বিপুল অংশকে নিজের পক্ষে আনতে পারবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আবার প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাছে ভালো অবস্থানে রয়েছেন আবিদুল। তার কোচিংকেন্দ্রিক একটা জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীই এখন ভোটার। এছাড়া জগন্নাথ হল, চারুকলার শিক্ষার্থীদেরও বেশির ভাগ ভোট তার পক্ষে থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ছাত্রীদেরও অনেক ভোটও তিনি টানতে পারেন। শিবির সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী সাদিক কায়েমও আছেন বেশ আলোচনায়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কারও কারও মাঝে শিবির নিয়ে অস্বস্তি থাকলেও সাদিক কায়েমের প্রতি আলাদা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ বিশেষ করে অমুসলিমদের ভোট তার জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও তারও রয়েছে কোচিংকেন্দ্রিক যোগাযোগ। এছাড়া ছাত্রীদেরও অনেক ভোট টানতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মতে, এই দুই প্রার্থী মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকতে পারেন। অন্যদিকে উমামা ফাতেমা সুইং ভোটারদের ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকতে পারেন। ছাত্রীদের ভোট ও অরাজনৈতিক একটি অংশের ভোট আসতে পারে উমামার পক্ষে। তিনিও ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকতে পারেন। আবার স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন গত তিন দিনে শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন বলে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন। তিনিও ইংরেজির শিক্ষক। অরাজনৈতিক ভোটারদের টেনে তিনি নতুন কোনো চমক দেখাতে পারেন বলে কেউ কেউ মনে করছেন। আলোচনায় আছেন আব্দুল কাদেরও।
জিএস পদে লড়াই হতে পারে মূলত ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের শেখ তানভীর বারী হামীম, ছাত্রশিবির সমর্থিত এসএম ফরহাদ, বাগছাস সমর্থিত আবু বাকের মজুমদারের মধ্যে। তিনজনই ক্যাম্পাসে পরিচিত মুখ। তাদের নিজস্ব ও প্যানেলগত ভোট রয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রদলের হামিম আগে থেকেই ক্যাম্পাস ও হলকেন্দ্রিক নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কারণে এগিয়ে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। অনাবাসিক, ছাত্রী ও অমুসলিম শিক্ষার্থীদের কাছেও তার অবস্থান বেশ ভালো। শিবির সমর্থিত এসএম ফরহাদও সংগঠনের নির্দিষ্ট ভোট ছাড়াও ক্যাম্পাসভিত্তিক সহশিক্ষা কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় তার অবস্থানও ভালো বলে জানা গেছে। বাগছাস সমর্থিত আবু বাকের মজুমদার সায়েন্স ফ্যাকাল্টির হওয়ায় ছাত্রদের তিনটি হলসহ ওই ফ্যাকাল্টির শিক্ষার্থীদের ভোট টানবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মূলত লড়াই হতে পারে এই তিন প্রার্থীর মধ্যে। এছাড়া ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেলের মেঘমল্লার বসুও চমক দেখাতে পারেন। কারণ অমুসলিম ও প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের ভোট টানতে পারেন। এর বাইরে ভিপি ও জিএস পদে বেশ কিছু নাম পরিচিত হলেও ভোটের লড়াইয়ে তাদের অবস্থান কেমন হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ : ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল, বিভাগ, টিএসসি, মল চত্বরসহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ডাকসু নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতেগোনা কিছু শিক্ষার্থীর ডাকসুতে ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফলে এটিই তাদের প্রথম ভোট হতে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা চাচ্ছেন তাদের ভোটটা এমন প্রার্থীদের দিতে চান যারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কাজ করবে।