মোঃ মামুন হোসেন: নারায়ণগঞ্জ শহরটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে পরিচিত। রাজধানী ঢাকা শহরের খুব কাছাকাছি অবস্থান, যোগাযোগের ভালো ব্যবস্থা, নদীপথ ও সড়কপথে সুবিধাজনক অবস্থান—সব মিলিয়ে নারায়ণগঞ্জ এক সময় পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক শহরের প্রতিচ্ছবি ছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দ্রুত নগরায়ন, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, খাল-নদী দখল ও অব্যবস্থাপনার কারণে বর্তমানে এই শহর ভয়াবহ জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে শহরের প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত পানি জমে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তোলে।একটু বৃষ্টি হলেই শহরের চাষাঢ়া, বঙ্গবন্ধু সড়ক, খানপুর, ডিআইটি রোড, দেওভোগ, মাসদাইর, হাজীগঞ্জ, জামতলা, বাবুরাইলসহ বিভিন্ন এলাকায় হাঁটুপানি জমে যায়। কোথাও কোথাও কোমরসমান পানিতেও মানুষ চলাচল করতে বাধ্য হয়। ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরা দুর্ভোগে পড়ে। রিকশা, সিএনজি কিংবা বাস চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। এমনকি হাসপাতালগুলোর প্রবেশ পথেও পানি জমে রোগী ও স্বজনদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। নারায়ণগঞ্জ শহরের জলাবদ্ধতার মূল কারণ হলো—অপরিকল্পিত নগরায়ন ও দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা। একদিকে যত্রতত্র বহুতল ভবন, মার্কেট ও রাস্তাঘাট নির্মাণ হচ্ছে; অন্যদিকে ড্রেন ও খালের মুখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শহরের প্রধান খালগুলোর বেশিরভাগই দখল হয়ে গেছে বা ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে কার্যকারিতা হারিয়েছে। জলাধার সংরক্ষণে প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপের অভাব এবং নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা না থাকায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, শহরের ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। কোথাও আবার ড্রেনের মুখেই নেই কোনো স্ল্যাব, ফলে ময়লা সরাসরি গিয়ে জমে ড্রেনের মুখে। বিভিন্ন স্থানে ড্রেনের পানি উল্টো রাস্তায় উঠে আসে, যা শুধু জলাবদ্ধতা নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।জলাবদ্ধতার কারণে প্রতিদিন লাখো মানুষের যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটে। শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, গৃহবধূ—সব শ্রেণির মানুষকে সীমাহীন কষ্টের মধ্য দিয়ে চলতে হয়। বাসাবাড়ির নিচতলা তলিয়ে যায়, রান্নাঘরে পানি ওঠে, টয়লেট ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দিতে হয় দুর্ঘটনা এড়াতে। ফলে অসুস্থ মানুষ, শিশু ও বৃদ্ধদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়।জলাবদ্ধতার কারণে প্রতিদিন লাখো মানুষের স্বাভাবিক যাতায়াত বিঘ্নিত হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ শহরের রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, দিনমজুর থেকে শুরু করে গৃহবধূ পর্যন্ত—সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে চরম ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে। অনেকে সময়মতো স্কুল, অফিস কিংবা জরুরি গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন না, যানজট ও পরিবহন সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে।শুধু বাহিরে নয়, জলাবদ্ধতা বাসার ভেতরেও প্রবেশ করছে। নিচতলা তলিয়ে যাচ্ছে, রান্নাঘর পানিতে ডুবে যাচ্ছে, এমনকি টয়লেট ব্যবহারেরও সুযোগ থাকছে না। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হচ্ছে দুর্ঘটনার আশঙ্কায়। ফলে অসুস্থ রোগী, শিশু ও বয়স্কদের অবস্থা হয়ে উঠছে আরও করুণ। অনেক বাসিন্দাকে পানি কাঁধে করে ঘর থেকে বের হতে হচ্ছে, কেউ কেউ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এই অবস্থা জনজীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তা ও স্বস্তির জায়গাটিও কেড়ে নিচ্ছে। জলাবদ্ধতা এখন একটি নগর-দুর্যোগ, যা দিনদিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।জলাবদ্ধতা কেবল শারীরিক কষ্টই নয়, মানসিক চাপও তৈরি করে। প্রতিনিয়ত এই পরিস্থিতির শিকার হয়ে মানুষ বিরক্ত, ক্লান্ত এবং হতাশ হয়ে পড়ে। অনেক জায়গায় জলাবদ্ধতার কারণে ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া, আমাশয়, চর্মরোগসহ বিভিন্ন পানি বাহিত রোগ।প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা সময় জলাবদ্ধতা নিরসনের কথা বলা হলেও বাস্তবে তার তেমন কার্যকর ফল পাওয়া যায়নি। মাঝে মাঝে কিছু ড্রেন পরিষ্কার করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ও সমন্বিত পরিকল্পনা। দখলমুক্ত খাল ও জলাধার পুনরুদ্ধার, আধুনিক ও কার্যকর ড্রেনেজ ব্যবস্থা, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং নাগরিক সচেতনতা—এই চারটি বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।করণীয় ও ভবিষ্যৎ ভাবনা-
১. খাল ও ড্রেন পুনঃখনন: শহরের প্রধান খালগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করে পুনঃখননের উদ্যোগ নিতে হবে।
২. পরিকল্পিত ড্রেন নির্মাণ: আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যা অতিরিক্ত বৃষ্টির পানিও দ্রুত নিষ্কাশন করতে পারবে।
৩. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: বাসাবাড়ি ও বাজারের বর্জ্য ড্রেনে না ফেলার জন্য জনসচেতনতা বাড়াতে হবে, প্রয়োজনে জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে।
4. সিটি কর্পোরেশনের তৎপরতা: প্রতিটি ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত সংখ্যক পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিয়ে ড্রেন পরিষ্কার রাখা এবং নিয়মিত মনিটরিং প্রয়োজন। নারায়ণগঞ্জ শহরের জলাবদ্ধতা এখন আর মৌসুমি সমস্যা নয়, এটি একটি স্থায়ী জনদুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। শহরবাসীর ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে এই সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতা ও দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। উন্নয়ন প্রকল্পের গ্ল্যামার দেখানোর চেয়ে নাগরিকদের বেঁচে থাকার উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি। আর তার জন্য চাই কার্যকর প্রশাসন, জবাবদিহিমূলক পৌর ব্যবস্থা এবং সচেতন নাগরিক সমাজ। জলাবদ্ধতামুক্ত আধুনিক নারায়ণগঞ্জ গড়ার প্রত্যাশাই আজ সকলের।
ঢাকা
,
বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৫ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :










নারায়ণগঞ্জ শহরের জলাবদ্ধতা: জনভোগান্তি চরমে
-
রুদ্রকন্ঠ ডেস্ক :
- আপডেট সময় ০৭:০০:৫৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫
- 6
জনপ্রিয় সংবাদ