রণজিৎ মোদক : স্মরণাতীত কাল হতে সনাতন আর্যধর্মের সাধনা ও আচারানুষ্ঠান বিভিন্ন ধারায় প্রভাহিত। তন্মধ্যে শাক্ত আর বৈষ্ণব ধারা দুটি পৃথক হলেও উদ্দেশ্য মূলত এক। বেদের যেমন দুটি ধারা একটি কর্মকান্ড অপরটি জ্ঞান কান্ড। কর্ম ও জ্ঞানের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকে লাভ করা যায়। জ্ঞানেই ঈশ্বর। বেদের একটি ধারা বিবিধ উপনিষদ, যজ্ঞকান্ডের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। মানব দেহকে অবলম্বন করে যোগশাস্ত্র উদ্ভুত তা সমস্ত হিন্দু সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করছে। বেদের ব্রহ্মকেই তন্ত্রশাস্ত্রে ব্রহ্মময়ী মহাশক্তি রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। যিনি সৃষ্টি, স্থিতি প্রলয়ের কর্তা তিনিই শক্তিরূপা চন্ডী।
যে শক্তি জীবের অন্তরের শক্তিকে জাগ্রত করেন তিনিই চন্ডী। আর সেই শক্তিই যখন জীবের দুর্গতি নাশ করেন তিনিই দুর্গা। চন্ডী মার্কন্ডে ও পুরানের অন্তর্গত। এতে সাতশ’ শ্লোক রয়েছে তাই একে সপ্তসতী নামে অভিহিত করা হয়েছে। শ্রী শ্রী চন্ডীতে আত্মার শক্তিকে জাগ্রত করার দিক নির্ণয় করা হয়েছে। যথ না হাঁটলে পথ ফুরায় না। সেই রূপ সাধনা না করলে সিদ্ধি লাভ সম্ভব নয়। দুঃখ, দারিদ্র, শোক বেদনাময় পৃথিবীতে মুলতঃ কেউ সুখী নয়।
সুখ নামের কল্পিত পাখির পিছে আমরা সবাই দৌড়ে বেড়াচ্ছি। কিন্তু সুখ কোথায়? মেধামুনি রাজ্যভ্রাষ্ট বিষাদগ্রস্ত মহারাজ সুরথ ও স্বজন কর্তৃক বিতাড়িত সমাধি নামক বৈশ্যকে মহাশক্তি সাধনা পথের মাধ্যমে যথাক্রমে স্বাধিকার ও মুক্তিলাভের উপায় নির্দেশ দেন। স্মরণাগত শিষ্য তত্ত¡ জিজ্ঞাসু ভক্ত মহারাজ সুরথ ও বিশ্য সমাধিকার নিকট মেধামুনি দেবাসুর সংগ্রামে বার বার পরাজিত দেবগণ কিরূপে আত্মশক্তির সমন্বয়ে মহাশক্তির উদ্বোধন ও বিকাশ সাধন করে পরিণামে নিজেদের স্বাধিকার পুনরুদ্ধার করেছিলেন তা বর্ণনা করেছেন।
সুরথ রাজা লক্ষ বলী দিয়ে সিদ্ধিলাভ করেন। মানব হৃদয়ে লাখ লাখ আশা লাখ ফনার চারিদিক বিস্তারিত হচ্ছে। কিন্তু লক্ষস্থির না হওয়ায় সিদ্ধিলাভ হচ্ছে না। কোনো কর্মে সিদ্ধিলাভ করতে হলে, প্রথমে লক্ষ্যকে স্থির করতে হবে। লক্ষ্যস্থির করে সিদ্ধি লাভের প্রত্যাশায় সাধনা করা চাই।
সমস্ত তন্ত্রের সার চন্ডীর মূল বেদে প্রতিষ্ঠিত। প্রথম চরিত্রে ঋগে¦দ স্বরূপা, মধ্যম চরিত্র যজুবেদ স্বরূপা এবং উত্তম চরিত্র সামবেদ স্বরূপা। চন্ডী গ্রন্থ তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে দেবী মহাত্ম্যের সূচনা, দ্বিতীয় ভাগে মূল গ্রন্থ, তৃতীয় ভাগে রহস্যক্রয়। এখানে পরমাত্মাকে নানান রূপে, নানাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সাধনার পথে বিঘœ বিপদ দূরীভ‚ত করার জন্য মনঅন্তঃ অন্তঃ মূখী মাতৃমুখী করে অভীষ্ট পথে অগ্রসর হতে হয়। নচেৎ মনের মাঝে মায়া প্রভাবে জ্ঞান শক্তিকে আবৃত করে রাখে। মেঘের আড়ালে সূর্য আবৃত হলে পৃথিবী অন্ধকারময় হয়। অজ্ঞানতার অন্ধকারে মানুষ যখন আবৃত, তখন সে সমস্ত কিছুই অন্ধকার অনুভব কমে। চন্ডী হচ্ছে শক্তিরূপা। জ্ঞান রূপে হৃদয়ে অবস্থান করেন। চন্ডীর উৎপত্তি সম্বন্ধে নানা মত প্রচলিত। কোন কোন পন্ডিতগণের মতে নর্মদা অ লে বা উজ্জীয়নীতে “শ্রী শ্রী চন্ডী” রচিত। কিন্তু পন্ডিত দক্ষিণারঞ্জণ শাস্ত্রী ঐতিহাসিক যুক্তি সহকারে উক্ত মত খন্ডণ করেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, সম্ভবত বাংলাদেশেই চন্ডীর জন্মস্থান। স্বামী বিবেকানন্দ প্রথমে নর্মদা তীরে মহামায়া চন্ডীর সাধনা করতেন। তিনি চন্ডীর উৎপত্তি স্থান সম্বন্ধে চিন্তা করতে করতে তন্ময় হয়ে মহামায়া মায়ের প্রতি অভিমান বশত নর্দমার জলে প্রাণ ত্যাগের উদ্দেশ্যে ঝাঁপ দিতে গেলে দেবী দৈববাণী করলেন, “তুমি বাংলার পূর্ব প্রান্তে চন্দ্রনাথ তীর্থে গিয়ে তার দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত নাভিগংগা আবিষ্কার কর। ঐ স্থানেই আমার আবির্ভাব হয়েছিলো। এদিক দিয়ে ইতিহাসের পাতা ও ভৌগলিক স্থান লক্ষ্য করলে দেখা যায়, চট্টগ্রাম শহর হতে এগার বার মাইল দূরে করলাভাঙ্গর পাহাড়ে অবস্থিত মেধাআশ্রম। এখানে বর্তমানেও একটি ক্ষণিকায়া পার্বত্য জলধারা প্রবাহিত। এর পাশেই মেধামুনির পদচিহ্ন নামে একটি পায়ের দাগ রয়েছে।
জগত সৃষ্টি লগ্নে ব্রহ্মা মধু-কৈটব দুই দ্বৈত্যের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে স্বয়ং বিষ্ণুর যোগ নিদ্রা ভঙ্গ করেন। তখন ব্রহ্মা যোগমায়ার স্তব করেন। কৃত্তিবাস কৃতবাংলা রামায়নে রামচন্দ্র ত্রেতা যুগের রাবন বধের অকাল বোধন করেন। শরৎকালে এ পূজা করা হয়। বসন্তকালে বাসন্তি পূজা করার নিয়ম রয়েছে। শ্রী চন্ডীর দ্বাদশ অধ্যায়ে ভগবতী বাক্যে উভয় পূজার নিয়ম রয়েছে। মহাভারতেও দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে দূর্গার (চন্ডীর) প্রার্থনা করার উপদেশ দিয়েছিলেন। পদ্ম পুরানে শ্রী চন্ডীর কাহিনী রয়েছে। কখনো উমা কখনো পার্বতী নামে চন্ডীকে সাজানো হয়েছে। সতীরূপে চন্ডীর দেহত্যাগ সে এক অপূর্ব কাহিনী। সতীর দেহ বায়ান্ন খন্ডে খন্ডিত করার পর তা বায়ান্ন তীর্থ ক্ষেত্রে রূপ নিয়েছে।
আদিকাল থেকেই ভারতবর্ষে শক্তি সাধনার ধারা চলে আসছে। ভারত বর্ষের বাইরেও তিব্বত, কাতার চীন, জাভা, ব্রহ্মদেশ, জাপান এমনকি বৌদ্ধ ধর্মেও শক্তি পূজা অনুপ্রবেশ করেছিলো। মাতৃভাবের সাধক রাম প্রসাদ, রাজা রাম কৃষ্ণ, বামাক্ষেপা, শর্বানন্দ ঠাকুর, সাধু তারা চরন, শ্রী শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী ও ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব বলতেন, “যিনি উপনিষদের পরব্রহ্ম তিনিই তন্ত্রের মহামায়া।” রাম প্রসাদ গেয়ে উঠলেন, কালীব্রহ্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি। গীতায় শ্রী কৃষ্ণ বলেছেন, পিতাহমস্য জগতোধাতা মাতা পিতামহঃ কলিযুগে বৈষ্ণব অবতার শ্রীচৈতন্য ভগবতে ভগবতীর কথা উল্লেখ করেছেন।
শ্রী শ্রী চন্ডীতত্তে¡ প্রবেশ করতে হলে, বর্তমান যুগের বহু মনীষী ও সাধকদের বিভিন্ন গ্রন্থ প্রনিধানযোগ্য। বঙ্কিমচন্দ্রের কমলা কান্তের দুর্গোৎসব নবীণ চন্দ্রেম ‘চন্ডীর ব্যাখ্যা’ সত্য দেবের সাধন সমর বিজয় কৃষ্ণের ‘মা আমার কাল কেন? নজরুলের শ্যামা সংগীত, স্বামী বিবেকানন্দের কালী দি মাদার অদ্বৈতনন্দের ‘দশমহাবিদ্যা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। জাতীয় কবি নজরুল তার আমি সৈনিক প্রবন্ধে মানুষের মাঝে অন্তরগত দু’টি রূপের কথা উল্লেখ করেছেন। পুরুষের মাঝে ¯েœহ-মায়া-মমতা মাতৃ হৃদয়ের চিত্রকেই তুলে ধরেছেন। নামী জাতিতে তার সৃষ্টি শক্তি কেন্দ্রভ‚ত রয়েছে। মাতৃরূপে ঈশ্বরকে সাধনা সহজ। মায়ের কাছে সন্তানদের লক্ষ দাবি। ¯েœহময়ী জননী সন্তানের বহু গঞ্জনা সহ্য করেও অসহায় সন্তানকে মমতায় কোলে তুলে সোহাগে জড়িয়ে ধরেন। ¯্রষ্টা আর সৃষ্টির মাঝে নিবিড় সম্পর্ক অনুভব করার জন্যই শ্রী চন্ডীতে মাতৃরূপা ঈশ্বরার বন্দনা করা হয়েছে। কুমারী পূজা এক জলন্ত প্রমাণ।
নারী জাতিতে তার সৃষ্টি শক্তি কেন্দ্রভ‚ত। মহামায়া যোগেশশ্বরী যোগমায়া বিশ্ব ব্যাপীনী হলেও নারী মূর্তিতে তার প্রকাশ। পুরানে বলা হয়েছে, সৃষ্টির আদিতে পরম পুরুষ নিজের লীলা বিস্তার করার জন্য নিজেকে নারী পুরুষ দু’ভাগে ভাগ করেছিলেন। জগন্মাতাকে আমরা শুধু মাতৃভাবে নয়, কন্যাভাবেও বরণ করি। দেবতাদের তেজ থেকে মহামায়ার সৃষ্টি। দেবতাদের মঙ্গলের জন্যই তিনি মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করে শুভ শক্তির জয় হয়। মহিষাসুর অশুভ শক্তির প্রতীক। তম গুণের অধিকারী। মানুষের মাঝে যতক্ষণ পর্যন্ত তম গুণ বিরাজ করবে ততক্ষণ পর্যন্ত মুক্তি বা মঙ্গল কামনা বৃথা। ভারতবর্ষে বর্ণে বর্ণে, গোত্রে গোত্রে হিংসা, যুদ্ধ, হত্যা চলছিলো। কিছুতেই সে হিংসার আগুন নেভানো সম্ভব নয়। তাই সে সময় রাজা কংস নারায়ণ তার রাজ্যের সকল সম্প্রদায়কে নিয়ে মহামঙ্গল কামনায় দূর্গা করেছিলেন। সেই থেকে ভারতবর্ষে দুর্গাপূজা প্রচলিত হয়। নিষ্ঠাবান হিন্দু আজও প্রতিদিন শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থ পাঠ করেন মঙ্গল কামনায়।
“সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্বার্থ সাধিকে।
শরণ্যে এম্বকে গৌরি নারায়ণে নমোহস্তুতে।”
শ্রীচন্ডী দূর্গা কারো মাতা, কারো কন্যা, কারো ভগ্নিরূপে শরতের শিউলী ফুটার স্পর্শ গন্ধ ছড়ায়ে ধুলার ধরণীতে আসেন। বাংলা-বাঙ্গালীর ঘরের কন্যা যেমন তার স্বামীগৃহ থেকে পিত্রালয়ে মাত্র কয়েক দিনের জন্য নায়র আসে। ঠিক তেমনই দুর্গা আসেন তার সন্তানদের নিয়ে। বাপের বাড়ি বেড়াতে ৭ম, ৮ম, ৯ম তিনদিন কত আনন্দ। কিন্তু দশমীর দিন করুণ বিদায়ের সুর বেজে উঠে। প্রিয় ভক্তদের চোখের কোণে অশ্রæ জমে ওঠে। পিতামাতা তার দুলালী কন্যাকে কিছুতেই বিদায় দিতে চায় না। দুলালীকে তো রাখাও যায় না। তাই অবশেষে আঁচল অশ্রæ মুছে তাকে বিদায় দিতে হয়। বাঙ্গালী হিন্দুদের দুর্গাপূজা সর্বজনীন। ছোট বড় সবাই এ পূজায় মহামিলনে মেতে উঠে। এখানে সবাই সবার একান্ত আপন হয়ে যায়। চন্ডার মধ্যে রূপকের সাহায্যে গভীর আধ্যাত্মিক তত্ত¡ বর্ণিত। তা অনুসরণ করাই আমাদের কর্তব্য। কারণ মানুষের হৃদয়ের মাঝে সৎ ও অসৎ প্রবৃত্তির যুদ্ধ সর্বদাই চলছে। মহাশক্তি জ্ঞানময়ী দুর্গার স্মরণ নিয়ে তিনি (দুর্গা) আমাদের অসৎ প্রবৃত্তিগুলো জাগ্রত করেনা শ্রী শ্রী চন্ডীতে দেবতা ও অনুসরদের সাথে বর্ণিত সমর (যুদ্ধ) প্রকৃতপক্ষে সাধণ সমর। মানুষের কাম ক্রোধ, লোভ মোহকে কুল কুন্তলিনী শক্তির সাহায্যে জয় করতে হয়। কামনা বাসনার ওপর থেকে সম্পূর্ণ বিরত না হলে, মহামুক্তির সন্ধান মিলে না। মহামুক্তির প্রত্যাশায় দুর্গাপূজার মহা আয়োজন। তাই দুর্গাপূজা বাঙ্গালী হিন্দুর জাতীয় মহোৎসব।