স্কোপোলামিন বা ভয়ংকর মাদক ডেভিলস ব্রিদ এ দেশে শয়তানের নিশ্বাস নামে পরিচিত। এটি একটি ভয়ংকর উপাদান যা অজান্তে কিংবা কৌশল-অপকৌশলে বা জোর করে নিশ্বাসের মাধ্যমে একবার মানব দেহে ছড়িয়ে দিতে পারলেই ওই ব্যক্তি কিছু সময়ের জন্য চলে যান প্রতারকদের নিয়ন্ত্রণে। ভয়ংকর এই উপাদানের প্রয়োগে ১৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা পর্যন্ত মানুষ তার নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকেন। প্রতারকদের কথা মতোই রোবটের মতো কাজ করেন।
বর্তমান সময়ে স্কোপোলামিন দেশে এক আতঙ্কের নাম। কোনো ধরনের অস্ত্র কিংবা ভয়ভীতি না দেখিয়েই টার্গেট করা ব্যক্তির সবকিছু লুটে নিতে অপরাধীরা এর ব্যবহার করছে। রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ভয়ংকর এই মাদক দিয়ে অপরাধীরা সাধারণ মানুষের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে।
গবেষণায় জানা গেছে, ভয়ংকর এই মাদকের সংস্পর্শে এলে ভুক্তভোগী নিজ ইচ্ছায় কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই সবকিছু তুলে দেন প্রতারকের হাতে। সত্য উদঘাটনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও এ মাদকটি ব্যবহার করেন। কলম্বিয়ায় উৎপন্ন হওয়া এ মাদকটি নিয়ে ১৮৮০ সালে সর্বপ্রথম জার্মান বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট লাদেনবার্গ গবেষণা শুরু করেন। ১৯২২ সালে এটি সর্বপ্রথম কারাবন্দিদের ওপর প্রয়োগ করা হয়। বর্তমানে মাদকটি মূলত প্রতারক চক্রের সদস্যরা ব্যবহার করে থাকে।
কলম্বিয়ায় উৎপত্তি হলেও ইকুয়েডর ও ভেনেজুয়েলাতেও মাদকটির যথেষ্ট বিস্তার রয়েছে। এ ছাড়া পেরু, আর্জেন্টিনা, চিলিসহ বিভিন্ন দেশে এটি মাদক হিসেবে ব্যাপকভাবে আলোচিত। অপরাধীরা বিভিন্ন বয়সি নারীদের দিয়ে নীলছবি ও অবাধ মিলনে বাধ্য করতে এটি ব্যবহার করে। ভয়ংকর মাদকটির ছোবল থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশও।
প্রতারণার শিকার পুরান ঢাকার নারিন্দা এলাকার বাসিন্দা খোদেজা বেগম। তিনি জানান, সবজি কিনতে তিনি বাজারের উদ্দেশে রওনা হয়ে কিছুদূর এগিয়ে দেখতে পান দুই কিশোর ঝগড়া করছে। তাদের একজন তার ব্যাগ রাখার জন্য খোদেজা বেগমের হাতে তুলে দেয়। ব্যাগ হাতে নেওয়ার পর মুহূর্তের মধ্যেই খোদেজা বেগম ওই কিশোরের নিয়ন্ত্রণে চলে যান। তাকে যেটিই বলা হয় সেটিই শুনতে থাকেন। এক পর্যায় তিনি তার কানের দুল, গলার চেইন ও হাতের চুড়ি দিয়ে দেন স্বেচ্ছায়।
কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা এলাকার বাসিন্দা মিনারা বেগম নামে আরেক ভুক্তভোগী সময়ের আলোকে জানান, এক দিন রিকশায় তাদের ১০ তলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় ভয়ংকর মাদক স্কোপোলামিন চক্রের এক নারী ও এক পুরুষ সদস্য। দেখে মনে হতে পারে তারা নিজ গন্তব্যে এসেছেন। ছেলেটি রিকশা ভাড়া দিয়ে বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করতে থাকে এবং নারী সদস্যটি দ্রুত ভবনের দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে। এ সময় ওই নারী তার কোমর থেকে কিছু একটা বের করে দরজার সামনে থাকা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে। এরপর প্রস্তুতি নিয়ে দরজায় নক দেয়।
দরজা খুলতেই সে নিজেকে একই ভবনের চতুর্থ চলার প্রতিবেশী হিসেবে পরিচয় দিয়ে কিছু বোঝার আগেই মিনারা বেগমের হাতে বাচ্চার জুতা তুলে দেয়। আর এতেই চক্রের সদস্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যান মিনারা বেগম। চাওয়া মাত্রই স্বেচ্ছায় দিয়ে দেন টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার ও মোবাইল ফোন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সায়েদুর রহমান বলেন, ওষুধ হিসেবে স্কোপোলামিনের ব্যবহার এখনও আছে। এটির মতো আরও বেশ কিছু ওষুধ চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহার করা হয়। এটি সত্য। স্কোপোলামিন প্রথম দিকে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময় গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে ট্রুথ সেরাম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এটি কাউকে ইনজেক্ট করা হলে সে সত্য কথা বলতে শুরু করে। কারণ তার মগজের ওপর নিজস্ব যে নিয়ন্ত্রণ সেটি চলে যায়। সে তখন অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, অন্যের কথা শুনতে থাকে।
ড. সায়েদুর রহমান আরও বলেন, যখন সত্য কথা বলানোর জন্য এটি ব্যবহার করা হয় তখন এটি ট্রুথ সেরাম। আর যখন এটি পাউডার ফর্মে নিশ্বাসের জন্য ব্যবহার করা হয় তখন তা ডেভিলস ব্রিথ। এ ছাড়া বমি অথবা মোশন সিকনেসের ক্ষেত্রেও এটি মেডিসিন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে স্কোপোলামিন মূলত পাউডার হিসেবে প্রতারণার কাজে ব্যবহার হচ্ছে। ভিজিটিং কার্ড, কাগজ, কাপড় কিংবা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে এটি লাগিয়ে কৌশলে টার্গেট করা ব্যক্তিদের নিশ্বাসের কাছাকাছি আনা হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, স্কোপোলামিন মানুষের নাকের চার থেকে ছয় ইঞ্চি কাছাকাছি এলেই নিশ্বাসের মাধ্যমে ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। নিশ্বাসের সঙ্গে প্রবেশের মাত্র ১০ মিনিট বা তারও আগে প্রভাব ফেলতে শুরু করে এটি। মেমোরি আর ব্রেন তখন সচেতনভাবে কাজ করতে পারে না। কারও ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হতে এক ঘণ্টা লাগে। আবার কেউ কেউ তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যেও স্বাভাবিক হতে পারেন না।
বাংলাদেশে শুরুতে ঢাকায় পাওয়া গেলেও পরে স্কোপোলামিন ব্যবহার করে প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতেও। যদিও এমন ঘটনার নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে মাদক কারবারিরা স্কোপোলামিন আনছে তাও একটি বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, আমাদের দেশে একসময় মানুষকে পাগল করে দেওয়ার জন্য দুধের মধ্যে ধুতরা বেটে খাওয়ানো হতো। ধুতরা ফুল কিন্তু এক ধরনের বিষ। ধুতরা ফুল থেকে উপাদান নিয়ে সিনথেটিক্যালি বানানো হয়েছে এই মাদক। মেক্সিকোর মাদকচক্র এই মাদক বানিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে।