ঢাকা , রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এখনও বেহাত ২০০ একর বনভূমি

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে প্রায় ২০০ একর বনভূমি প্রভাবশালীদের কাছে অবৈধ দখলে রয়েছে। জাল বিএস খতিয়ান তৈরি করে এবং প্রভাব খাটিয়ে এসব জমি জবরদখলে রেখেছেন প্রভাবশালীরা। বনভূমির এসব জায়গায় পুকুর খনন করে মাছ চাষ, চিংড়ি ঘের ও লবণ চাষ করে ভোগ করা হচ্ছে। অর্ধশত বছর আইনি লড়াইয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায় পাওয়ার পরও ওই জমি উদ্ধারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি জেলা প্রশাসন।

এ প্রসঙ্গে উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, বন বিভাগের ওই জায়গায় আমাদের পক্ষে হাইকোর্টের রায় আছে। স্থানীয় সাবেক চেয়ারম্যান লোক দেওয়ার কথা বললেও ওখানে গিয়ে লোক নিয়ে মারামারি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। ওখানে উচ্ছেদ অভিযান করা আমাদের কাজ নয়। উচ্ছেদ অভিযানের জন্য আমরা জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছি। চিঠির জবাব আমরা এখনও পর্যন্ত পাইনি।

বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন আক্তার বলেন, বেদখলে থাকা বনভূমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসন থেকে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা পাইনি। জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উপকূলীয় বন বিভাগের ছনুয়া রেঞ্জের খুদুকখালী মৌজায় সাগরতীরের ভূমিতে ২০০৭, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে বিভিন্ন ধাপে ম্যানগ্রোভ বাগান সৃজন করা হয়। অভিযোগ আছে, ২০০৯ সালের ১ ডিসেম্বর ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে ৮০-৯০ জন লোক উপকূলীয় বন বিভাগের ১ লাখ ৮০ হাজার গাছ কেটে ২০০ একর জমি দখল করে নেয়। আনুমানিক ২ কোটি টাকা মূল্যের বাইন ও কেওড়া গাছ কেটে সন্ত্রাসীরা ওই জায়গায় চিংড়ি ঘের ও লবণ চাষের জন্য অবৈধভাবে ঘের স্থাপন করে। এ ঘটনায় বাঁশখালী থানায় মামলা হয়। মামলা নং-০১/২০০৯। পরবর্তী সময়ে আসামিদের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করে। হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে চিংড়ি ঘের ও লবণ চাষের ক্ষেত্র প্রস্তুত, ভেকু দিয়ে পুকুর খনন, লোনা পানি প্রবেশ ও লেবার শেড নির্মাণ করায় ২০১১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বন বিভাগের বিট কর্মকর্তা বাঁশখালী থানায় মামলা করেন। মামলা নং-৮/৩৪।

উপকূলীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, খুদুকখালী মৌজার ৬ ও ১০০১ দাগের প্রায় ৯০ একর জমি বন বিভাগকে হস্তান্তর করা হয়। একই দাগের প্রায় ১৬ একর জমির বন আইনের ৬ ধারা জারি করে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করা হয়। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিয়াল করপোরেশনের ইজারা বাতিল এবং বন বিভাগের অনুকূলে হস্তান্তর করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর জাল বিএস খতিয়ান তৈরি করে ছনুয়া রেঞ্জের খুদুকখালী মৌজার ১ নং খাস খতিয়ানের ৯৯ একর জমি বিক্রি করে দেন ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ ও সাবেক চেয়ারম্যান বশির আহমদের ছেলেরা। বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ সায়ান এস্কর্প হোল্ডিংস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ওই জমি কিনে নেন। আইনি লড়াইয়ে উপকূলীয় বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসন ওই জমি ফিরে পেলেও আজ অবধি দখলমুক্ত করতে পারেনি।
মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উপকূলীয় বন বিভাগের ছনুয়া রেঞ্জের খুদুকখালী মৌজার খাস খতিয়ানভুক্ত ৯০ একর জমি নারকেল বাগান করার শর্তে ২৫ বছরের জন্য ইজারা নেয় ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। জেলা প্রশাসন ১৯৬৬ সালে শীষ মোহাম্মদ ও বশির আহমদকে এই ইজারা দেয়। কিন্তু নারকেল বাগান না করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা লবণ মাঠ ও চিংড়ি ঘের এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহার করেন। ইজারার শর্ত ভঙ্গ করার অভিযোগে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ১৯৬৭ সালে ইজারা বাতিল করেন। এই নির্দেশের বিরুদ্ধে ইজারা গ্রহীতারা ভূমি আপিল বোর্ডে আপিল করেন। বোর্ড ইজারাদারকে লবণ মাঠ না করে নারকেল বাগান করার নির্দেশ দিয়ে ইজারা বহাল রাখে। এসব জমি ইজারা দেওয়া ও বাতিল নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ইজারাদার পক্ষ ও জেলা প্রশাসন আইনি লড়াইয়ে যুক্ত হয়। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারি জমির ইজারা বাতিল করে জেলা প্রশাসনের পক্ষে রায় দিয়ে ওই জমি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন প্রশাসনের কর্মকর্তার স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে জমির স্থায়ী বন্দোবস্তের খতিয়ান সৃজন করে। বিষয়টি স্থানীয়ভাবে জানার পর জেলা প্রশাসকের পক্ষে সরেজমিনে তদন্ত করা হয়। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তার স্বাক্ষর জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন ১৯৮৭ সালের ২২ ডিসেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ভূমি মন্ত্রণালয় ১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠি বিভাগীয় কমিশনার বরাবর পাঠায়। চিঠিতে জমির ইজারা বাতিল ও জড়িতদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন বিভাগে অভিযোগ করার কথা বলা হয়।

এর আগে ইজারা বাতিলের আদেশের বিরুদ্ধে ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন ১৯৮১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মামলা করে। চট্টগ্রামের সিনিয়র সহকারী জজ আদালত ১৯৯১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইজারাগ্রহীতার পক্ষে রায় দেন। প্রশাসন নিম্ন আদালতের এই আদেশ খারিজ করার জন্য জেলা জজ আদালতে মামলা করে। শুনানি শেষে জেলা জজ আদালত ১৯৯৪ সালে প্রশাসনের আবেদন বাতিল করেন। নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৫ সালে প্রশাসন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিভিশন মামলা করা হয়। নানা ধাপ শেষে ২০১৭ সালে আপিল বিভাগ ইজারা চুক্তি বাতিল ঘোষণা করেন।

উপকূলীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আপিল বিভাগের আদেশ কার্যকর করার জন্য ২০১৮ সালের ১১ মার্চ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বরাবর চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে ৯৯ একর জমি পুনরুদ্ধারের অনুরোধ জানানো হয়। ২৬ মার্চ জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জমির বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জানানোর জন্য একটি চিঠি সহকারী কমিশনার (ভূমি) বাঁশখালীকে পাঠানো হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাহমুদ উল্লাহ মারুফ ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। চিঠি পাঠানোর চার বছর পরও চিঠির উত্তর পাওয়া যায়নি।

এদিকে গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর জমিগুলো দখলমুক্ত করতে নড়েচড়ে বসে উপকূলীয় বন বিভাগ। গত ২৬ আগস্ট ওই জমিতে দখলমুক্ত ঘোষণা করে লাল পতাকা উত্তোলন করে বন বিভাগের লোকজন। কিন্তু সেখানে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে উত্তোলন করা পতাকা ছিঁড়ে ফেলেন ছনুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদের অনুগত হেফাজুল করিম, মফিজুল করিম ও শাহাদাত করিম নামের তিন ব্যক্তি।

স্থানীয় বাসিন্দা আবু সিদ্দিক মাস্টার বলেন, খাসজমিগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে লবণ চাষ ও বর্ষা মৌসুমে চিংড়ি ঘের করা হয়। বন বিভাগের লোকজনের দাবি, তাদের জনবল কম। ছনুয়ার সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক চৌধুরী দখল উচ্ছেদ অভিযানে ২ হাজার লোক দিয়ে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দিলেও বন বিভাগের কর্মকর্তারা দখল বুঝে নিতে রাজি হননি।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানার জন্য ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান এম. হারুনুর রশীদকে কল করা হলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে হারুনুর রশীদ আত্মগোপনে আছেন।

আপলোডকারীর তথ্য

Rudra Kantho24

জনপ্রিয় সংবাদ

এখনও বেহাত ২০০ একর বনভূমি

আপডেট সময় ০৯:৫৭:০৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২১ অক্টোবর ২০২৪

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে প্রায় ২০০ একর বনভূমি প্রভাবশালীদের কাছে অবৈধ দখলে রয়েছে। জাল বিএস খতিয়ান তৈরি করে এবং প্রভাব খাটিয়ে এসব জমি জবরদখলে রেখেছেন প্রভাবশালীরা। বনভূমির এসব জায়গায় পুকুর খনন করে মাছ চাষ, চিংড়ি ঘের ও লবণ চাষ করে ভোগ করা হচ্ছে। অর্ধশত বছর আইনি লড়াইয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায় পাওয়ার পরও ওই জমি উদ্ধারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি জেলা প্রশাসন।

এ প্রসঙ্গে উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, বন বিভাগের ওই জায়গায় আমাদের পক্ষে হাইকোর্টের রায় আছে। স্থানীয় সাবেক চেয়ারম্যান লোক দেওয়ার কথা বললেও ওখানে গিয়ে লোক নিয়ে মারামারি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। ওখানে উচ্ছেদ অভিযান করা আমাদের কাজ নয়। উচ্ছেদ অভিযানের জন্য আমরা জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছি। চিঠির জবাব আমরা এখনও পর্যন্ত পাইনি।

বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন আক্তার বলেন, বেদখলে থাকা বনভূমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসন থেকে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা পাইনি। জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উপকূলীয় বন বিভাগের ছনুয়া রেঞ্জের খুদুকখালী মৌজায় সাগরতীরের ভূমিতে ২০০৭, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে বিভিন্ন ধাপে ম্যানগ্রোভ বাগান সৃজন করা হয়। অভিযোগ আছে, ২০০৯ সালের ১ ডিসেম্বর ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে ৮০-৯০ জন লোক উপকূলীয় বন বিভাগের ১ লাখ ৮০ হাজার গাছ কেটে ২০০ একর জমি দখল করে নেয়। আনুমানিক ২ কোটি টাকা মূল্যের বাইন ও কেওড়া গাছ কেটে সন্ত্রাসীরা ওই জায়গায় চিংড়ি ঘের ও লবণ চাষের জন্য অবৈধভাবে ঘের স্থাপন করে। এ ঘটনায় বাঁশখালী থানায় মামলা হয়। মামলা নং-০১/২০০৯। পরবর্তী সময়ে আসামিদের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করে। হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে চিংড়ি ঘের ও লবণ চাষের ক্ষেত্র প্রস্তুত, ভেকু দিয়ে পুকুর খনন, লোনা পানি প্রবেশ ও লেবার শেড নির্মাণ করায় ২০১১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বন বিভাগের বিট কর্মকর্তা বাঁশখালী থানায় মামলা করেন। মামলা নং-৮/৩৪।

উপকূলীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, খুদুকখালী মৌজার ৬ ও ১০০১ দাগের প্রায় ৯০ একর জমি বন বিভাগকে হস্তান্তর করা হয়। একই দাগের প্রায় ১৬ একর জমির বন আইনের ৬ ধারা জারি করে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করা হয়। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিয়াল করপোরেশনের ইজারা বাতিল এবং বন বিভাগের অনুকূলে হস্তান্তর করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর জাল বিএস খতিয়ান তৈরি করে ছনুয়া রেঞ্জের খুদুকখালী মৌজার ১ নং খাস খতিয়ানের ৯৯ একর জমি বিক্রি করে দেন ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ ও সাবেক চেয়ারম্যান বশির আহমদের ছেলেরা। বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ সায়ান এস্কর্প হোল্ডিংস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ওই জমি কিনে নেন। আইনি লড়াইয়ে উপকূলীয় বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসন ওই জমি ফিরে পেলেও আজ অবধি দখলমুক্ত করতে পারেনি।
মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উপকূলীয় বন বিভাগের ছনুয়া রেঞ্জের খুদুকখালী মৌজার খাস খতিয়ানভুক্ত ৯০ একর জমি নারকেল বাগান করার শর্তে ২৫ বছরের জন্য ইজারা নেয় ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। জেলা প্রশাসন ১৯৬৬ সালে শীষ মোহাম্মদ ও বশির আহমদকে এই ইজারা দেয়। কিন্তু নারকেল বাগান না করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা লবণ মাঠ ও চিংড়ি ঘের এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহার করেন। ইজারার শর্ত ভঙ্গ করার অভিযোগে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ১৯৬৭ সালে ইজারা বাতিল করেন। এই নির্দেশের বিরুদ্ধে ইজারা গ্রহীতারা ভূমি আপিল বোর্ডে আপিল করেন। বোর্ড ইজারাদারকে লবণ মাঠ না করে নারকেল বাগান করার নির্দেশ দিয়ে ইজারা বহাল রাখে। এসব জমি ইজারা দেওয়া ও বাতিল নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ইজারাদার পক্ষ ও জেলা প্রশাসন আইনি লড়াইয়ে যুক্ত হয়। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারি জমির ইজারা বাতিল করে জেলা প্রশাসনের পক্ষে রায় দিয়ে ওই জমি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন প্রশাসনের কর্মকর্তার স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে জমির স্থায়ী বন্দোবস্তের খতিয়ান সৃজন করে। বিষয়টি স্থানীয়ভাবে জানার পর জেলা প্রশাসকের পক্ষে সরেজমিনে তদন্ত করা হয়। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তার স্বাক্ষর জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন ১৯৮৭ সালের ২২ ডিসেম্বর ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ভূমি মন্ত্রণালয় ১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠি বিভাগীয় কমিশনার বরাবর পাঠায়। চিঠিতে জমির ইজারা বাতিল ও জড়িতদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন বিভাগে অভিযোগ করার কথা বলা হয়।

এর আগে ইজারা বাতিলের আদেশের বিরুদ্ধে ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন ১৯৮১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মামলা করে। চট্টগ্রামের সিনিয়র সহকারী জজ আদালত ১৯৯১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইজারাগ্রহীতার পক্ষে রায় দেন। প্রশাসন নিম্ন আদালতের এই আদেশ খারিজ করার জন্য জেলা জজ আদালতে মামলা করে। শুনানি শেষে জেলা জজ আদালত ১৯৯৪ সালে প্রশাসনের আবেদন বাতিল করেন। নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৫ সালে প্রশাসন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিভিশন মামলা করা হয়। নানা ধাপ শেষে ২০১৭ সালে আপিল বিভাগ ইজারা চুক্তি বাতিল ঘোষণা করেন।

উপকূলীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আপিল বিভাগের আদেশ কার্যকর করার জন্য ২০১৮ সালের ১১ মার্চ অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বরাবর চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে ৯৯ একর জমি পুনরুদ্ধারের অনুরোধ জানানো হয়। ২৬ মার্চ জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জমির বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জানানোর জন্য একটি চিঠি সহকারী কমিশনার (ভূমি) বাঁশখালীকে পাঠানো হয়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাহমুদ উল্লাহ মারুফ ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। চিঠি পাঠানোর চার বছর পরও চিঠির উত্তর পাওয়া যায়নি।

এদিকে গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর জমিগুলো দখলমুক্ত করতে নড়েচড়ে বসে উপকূলীয় বন বিভাগ। গত ২৬ আগস্ট ওই জমিতে দখলমুক্ত ঘোষণা করে লাল পতাকা উত্তোলন করে বন বিভাগের লোকজন। কিন্তু সেখানে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে উত্তোলন করা পতাকা ছিঁড়ে ফেলেন ছনুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদের অনুগত হেফাজুল করিম, মফিজুল করিম ও শাহাদাত করিম নামের তিন ব্যক্তি।

স্থানীয় বাসিন্দা আবু সিদ্দিক মাস্টার বলেন, খাসজমিগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে লবণ চাষ ও বর্ষা মৌসুমে চিংড়ি ঘের করা হয়। বন বিভাগের লোকজনের দাবি, তাদের জনবল কম। ছনুয়ার সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক চৌধুরী দখল উচ্ছেদ অভিযানে ২ হাজার লোক দিয়ে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দিলেও বন বিভাগের কর্মকর্তারা দখল বুঝে নিতে রাজি হননি।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানার জন্য ছনুয়া ইউপি চেয়ারম্যান এম. হারুনুর রশীদকে কল করা হলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে হারুনুর রশীদ আত্মগোপনে আছেন।