ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো ষড়যন্ত্রই কাজে আসবে না

রাজধানীতে বিপুলসংখ্যক মানুষের ঢল নামিয়ে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে বর্ণাঢ্য র‌্যালি করেছে বিএনপি। এর মাধ্যমে বিগত ১৭ বছর পর রাজধানীতে বাধাহীনভাবে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিতে সক্ষম হয় দলটি। এদিন দলের নেতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন সমর্থক আর সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে পুরো নয়াপল্টন এলাকা ছাড়িয়ে আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়।

শোভাযাত্রাপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণকে আমি একটি বিষয় আবারও স্মরণ করিয়ে সর্তক থাকতে অনুরোধ জানাতে চাই, আমি নিজেও সর্তক থাকতে চাই। গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র এখনও কিন্তু থেমে নেই। অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা দেশে-বিদেশে, শাসনে-প্রশাসনে এখনও সক্রিয়। এই অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। জাতীয়তাবাদী শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো ষড়যন্ত্র কাজে আসবে না।

বিএনপি ঘোষিত শোভাযাত্রায় অংশ নিতে শুক্রবার বেলা ১১টা থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড, থানা ও ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে আসা নেতাকর্মীরা জড়ো হতে শুরু করেন। মোড়ে মোড়ে এবং অলিগলিতে জমায়েত হয়ে বিভিন্ন সেøাগানে রাজপথ প্রকম্পিত করে তোলেন তারা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মতিঝিল থেকে ফকিরেরপুল-কাকরাইল ছাড়িয়ে মৎস্যভবন পর্যন্ত হাজার হাজার নেতাকর্মীর এই সমাবেশ জনসমুদ্রে রূপ নেয়। বিকাল ৪টার দিকে নয়াপল্টন থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয়। কাকরাইলের নাইটিংগেল রেস্তোরাঁর মোড় থেকে শুরু হওয়া শোভাযাত্রাটি কাকরাইল মোড়-কাকরাইল মসজিদ-মৎস্যভবন-ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট-শাহবাগ-হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-বাংলামোটর-কারওয়ান বাজার-ফার্মগেট হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে গিয়ে শেষ হয়। আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এই শোভাযাত্রার কারণে গুরুত্বপূর্ণ সড়কে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়। বন্ধের দিনও যানজটে নাকাল হতে হয় ঢাকাবাসীকে। অনেক যাত্রী হেঁটে গন্তব্যে যেতে বাধ্য হন।

রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অস্থায়ী মঞ্চে বেলা ৩টায় পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নয়াপল্টন থেকে শান্তিনগর মোড় বা মালিবাগ পর্যন্ত পুলিশের অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিএনপি শোভাযাত্রা করেছে। এই রুটের বাইরে প্রায় দেড়যুগ পরে এবার প্রথম মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ পর্যন্ত শোভাযাত্রা করে বিএনপি।

র‌্যালিতে অংশ নেওয়া নেতাকর্মীরা সাবেক রাষ্ট্রপতি শহিদ জিয়াউর রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবিসংবলিত ব্যানার, ফেস্টুন, জাতীয় এবং দলীয় পতাকা ও বিভিন্ন রঙের ক্যাপ পরে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া ধানক্ষেতে কর্মরত কৃষকের সাজে নেতাকর্মীরা শোভাযাত্রায় যোগ দেন। তারা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ট্রাক নিয়ে ও বিভিন্ন রঙের টি-শার্ট পরে শোভাযাত্রায় অংশ নেন। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় নেতাকর্মীদের হাতে ছিল ধানের শীষের ছড়া ও নানা রঙের পতাকা। ছিল ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার নানা দৃশ্য। শোভাযাত্রায় শেখ হাসিনাকে প্রতীকীভাবে খাঁচায় বন্দি করে উপস্থাপন করা হয়েছে।

দেখা গেছে, একটি খাঁচার মধ্যে গোলাপি রঙের শাড়ি ও চোখে সানগ্লাস পরে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবয়স্ক এক নারী। যার সাজগোজ অনেকটা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার মতো। এই নারীর মুখমণ্ডল সাজানো হয় দানবের মতো আর মাথায় ছিল দুটি শিং। খাঁচার সঙ্গে আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিভিন্ন অন্যায়-অত্যাচার আর লুটপাটের তথ্য ছিল।

বিভিন্ন পথ ধরে শোভাযাত্রা চলার সময়ে রাস্তার দুই পাশে হাজার হাজার মানুষ করতালি দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিনন্দন জানায়। নেতারা হাত তুলে দর্শকদের অভিবাদনের জবাব দেন।

বেলা ৩টা ২৫ মিনিটে উদ্বোধনী বক্তব্য শুরু করেন তারেক রহমান। ৪ মিনিটের বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে-এটি আজ জনগণের চাওয়া। আসুন এই লাখ জনতার মিছিলকে কোনোভাবেই বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না।

ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ফ্যাসিবাদের পতন হওয়ায় জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের শত্রু-মিত্র চেনার দিন। আর আজ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের শত্রু চিহ্নিত করার দিন। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে আর কেউ দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করতে পারবে না।

৭ নভেম্বরের শিক্ষায় উদ্বৃত্ত লাখো মানুষের মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের অভিনন্দন জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, আজকের এই মিছিল থেকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী যে জনতা, সেই জনতাকে জানাই বীরোচিত অভিনন্দন। রাজধানী ঢাকার রাজপথে আজ লাখো জনতার এই মিছিল বাংলাদেশের পক্ষের শক্তিকে ৭ নভেম্বরের অন্তর্নিহিত শিক্ষায় দীক্ষিত করার মিছিল, লাখো জনতার আজকের এই মিছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আহত অসংখ্য ছাত্র-জনতা এবং হাজারো শহিদের স্বপ্নে একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক, মানবিক বাংলাদেশ গড়ায় প্রত্যয়ী মিছিল।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী অপশক্তি জেনে রাখুক-রাজধানীর রাজপথের আজকের এই সমাবেশ ও মিছিল কারও বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তোলার মিছিল নয় বরং রাজপথের জনতার আজকের এই মিছিল বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষার মিছিল, নিজের অধিকার রক্ষার মিছিল, নিজের ভোট প্রয়োগের অধিকার প্রতিষ্ঠার মিছিল।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশে যাতে আর কখনোই ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচার ফিরে আসতে না পারে, সে জন্য প্রতিটি নাগরিকের সরাসরি ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার সক্ষমতা অর্জন জরুরি। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জনগণের ভোটের প্রতি যতক্ষণ মুখাপেক্ষী করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণ গণতন্ত্রের সুফল পাবে না। এমনকি স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশেও স্বল্প আয়ের মানুষকে বাজার সিন্ডিকেটের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা অসম্ভব। যদি না মানুষের সরাসরি ভোটের অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পারি।

সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার দিন, ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশকে আধিপত্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করার দিন। দীর্ঘ ১৭ বছর আমরা লড়াই করেছি, সংগ্রাম করেছি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এই ১৭ বছরে আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছিল। বাংলাদেশকে একটা লুটপাটের রাজত্ব বানিয়ে একে মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। শেখ হাসিনা তার পরিবার, তার সহকর্মীদের নিয়ে এ দেশকে লুটপাট করেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার দোসররা দেশের সর্বত্র ঘাপটি মেরে বসে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে সর্তক থাকতে হবে।

শোভাযাত্রায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, সিনিয়র নেতা মোহাম্মদ শাহজাহান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, মজিবুর রহমান সারোয়ার, খায়রুল কবির খোকন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, আবদুস সালাম আজাদ, রশিদুজ্জামান মিল্লাহ, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, রফিকুল ইসলাম, সাইফুল আলম নিরব, রাকিবুল ইসলাম বকুল, নিলোফার চৌধুরী মনি, তাইফুল ইসলাম টিপু, রফিকুল আলম মজনু, আমিনুল হক, এম মোনায়েম মুন্না, নরুল ইসলাম নয়ন, এসএম জিলানি, রাজীব আহসান, হাসান জাফির তুহিন, রাকিকুল ইসলাম রাকিব, নাছির উদ্দিন নাছির ও নিপুণ রায় চৌধুরীসহ কেন্দ্রীয় এবং অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বিএনপি মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা একটি খোলা ট্রাকে এই মিছিলে অংশ নেন। ঢাকা মহানগরের সব ওয়ার্ডসহ মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নরসিংদী ও আশপাশের জেলাগুলো থেকে বাসে করে নেতা-কর্মীরা শোভাযাত্রায় অংশ নেন। রাজধানী ছাড়াও বিভাগীয় শহরগুলোতেও একযোগে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।

প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার ছিল ৭ নভেম্বর। দিনটি ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করে বিএনপি। দিবসটি উপলক্ষে আলোচনা সভা ও শোভাযাত্রাসহ ১০ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটি।

উল্লেখ্য, রাজধানী ছাড়াও বিভাগীয় শহরগুলোতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার এই কর্মসূচি একযোগে আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া গত ৭ নভেম্বর বিএনপির নেতাকর্মীদের নিয়ে বিএনপি মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির সদস্যরা সকালে শেরেবাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ওই দিন বিকালে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) শিল্পীরা এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।

আপলোডকারীর তথ্য

Rudra Kantho24

ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো ষড়যন্ত্রই কাজে আসবে না

আপডেট সময় ১০:৪৪:০৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৯ নভেম্বর ২০২৪

রাজধানীতে বিপুলসংখ্যক মানুষের ঢল নামিয়ে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে বর্ণাঢ্য র‌্যালি করেছে বিএনপি। এর মাধ্যমে বিগত ১৭ বছর পর রাজধানীতে বাধাহীনভাবে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিতে সক্ষম হয় দলটি। এদিন দলের নেতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন সমর্থক আর সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে পুরো নয়াপল্টন এলাকা ছাড়িয়ে আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়।

শোভাযাত্রাপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণকে আমি একটি বিষয় আবারও স্মরণ করিয়ে সর্তক থাকতে অনুরোধ জানাতে চাই, আমি নিজেও সর্তক থাকতে চাই। গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র এখনও কিন্তু থেমে নেই। অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা দেশে-বিদেশে, শাসনে-প্রশাসনে এখনও সক্রিয়। এই অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। জাতীয়তাবাদী শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো ষড়যন্ত্র কাজে আসবে না।

বিএনপি ঘোষিত শোভাযাত্রায় অংশ নিতে শুক্রবার বেলা ১১টা থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড, থানা ও ঢাকার আশপাশের জেলা থেকে আসা নেতাকর্মীরা জড়ো হতে শুরু করেন। মোড়ে মোড়ে এবং অলিগলিতে জমায়েত হয়ে বিভিন্ন সেøাগানে রাজপথ প্রকম্পিত করে তোলেন তারা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মতিঝিল থেকে ফকিরেরপুল-কাকরাইল ছাড়িয়ে মৎস্যভবন পর্যন্ত হাজার হাজার নেতাকর্মীর এই সমাবেশ জনসমুদ্রে রূপ নেয়। বিকাল ৪টার দিকে নয়াপল্টন থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয়। কাকরাইলের নাইটিংগেল রেস্তোরাঁর মোড় থেকে শুরু হওয়া শোভাযাত্রাটি কাকরাইল মোড়-কাকরাইল মসজিদ-মৎস্যভবন-ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট-শাহবাগ-হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-বাংলামোটর-কারওয়ান বাজার-ফার্মগেট হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে গিয়ে শেষ হয়। আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এই শোভাযাত্রার কারণে গুরুত্বপূর্ণ সড়কে ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হয়। বন্ধের দিনও যানজটে নাকাল হতে হয় ঢাকাবাসীকে। অনেক যাত্রী হেঁটে গন্তব্যে যেতে বাধ্য হন।

রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অস্থায়ী মঞ্চে বেলা ৩টায় পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শুরু হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নয়াপল্টন থেকে শান্তিনগর মোড় বা মালিবাগ পর্যন্ত পুলিশের অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিএনপি শোভাযাত্রা করেছে। এই রুটের বাইরে প্রায় দেড়যুগ পরে এবার প্রথম মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ পর্যন্ত শোভাযাত্রা করে বিএনপি।

র‌্যালিতে অংশ নেওয়া নেতাকর্মীরা সাবেক রাষ্ট্রপতি শহিদ জিয়াউর রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবিসংবলিত ব্যানার, ফেস্টুন, জাতীয় এবং দলীয় পতাকা ও বিভিন্ন রঙের ক্যাপ পরে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া ধানক্ষেতে কর্মরত কৃষকের সাজে নেতাকর্মীরা শোভাযাত্রায় যোগ দেন। তারা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ট্রাক নিয়ে ও বিভিন্ন রঙের টি-শার্ট পরে শোভাযাত্রায় অংশ নেন। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় নেতাকর্মীদের হাতে ছিল ধানের শীষের ছড়া ও নানা রঙের পতাকা। ছিল ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যার নানা দৃশ্য। শোভাযাত্রায় শেখ হাসিনাকে প্রতীকীভাবে খাঁচায় বন্দি করে উপস্থাপন করা হয়েছে।

দেখা গেছে, একটি খাঁচার মধ্যে গোলাপি রঙের শাড়ি ও চোখে সানগ্লাস পরে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবয়স্ক এক নারী। যার সাজগোজ অনেকটা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার মতো। এই নারীর মুখমণ্ডল সাজানো হয় দানবের মতো আর মাথায় ছিল দুটি শিং। খাঁচার সঙ্গে আওয়ামী লীগ শাসনামলে বিভিন্ন অন্যায়-অত্যাচার আর লুটপাটের তথ্য ছিল।

বিভিন্ন পথ ধরে শোভাযাত্রা চলার সময়ে রাস্তার দুই পাশে হাজার হাজার মানুষ করতালি দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিনন্দন জানায়। নেতারা হাত তুলে দর্শকদের অভিবাদনের জবাব দেন।

বেলা ৩টা ২৫ মিনিটে উদ্বোধনী বক্তব্য শুরু করেন তারেক রহমান। ৪ মিনিটের বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে-এটি আজ জনগণের চাওয়া। আসুন এই লাখ জনতার মিছিলকে কোনোভাবেই বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না।

ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ফ্যাসিবাদের পতন হওয়ায় জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের শত্রু-মিত্র চেনার দিন। আর আজ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের শত্রু চিহ্নিত করার দিন। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে আর কেউ দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করতে পারবে না।

৭ নভেম্বরের শিক্ষায় উদ্বৃত্ত লাখো মানুষের মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের অভিনন্দন জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, আজকের এই মিছিল থেকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী যে জনতা, সেই জনতাকে জানাই বীরোচিত অভিনন্দন। রাজধানী ঢাকার রাজপথে আজ লাখো জনতার এই মিছিল বাংলাদেশের পক্ষের শক্তিকে ৭ নভেম্বরের অন্তর্নিহিত শিক্ষায় দীক্ষিত করার মিছিল, লাখো জনতার আজকের এই মিছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আহত অসংখ্য ছাত্র-জনতা এবং হাজারো শহিদের স্বপ্নে একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক, মানবিক বাংলাদেশ গড়ায় প্রত্যয়ী মিছিল।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী অপশক্তি জেনে রাখুক-রাজধানীর রাজপথের আজকের এই সমাবেশ ও মিছিল কারও বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তোলার মিছিল নয় বরং রাজপথের জনতার আজকের এই মিছিল বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষার মিছিল, নিজের অধিকার রক্ষার মিছিল, নিজের ভোট প্রয়োগের অধিকার প্রতিষ্ঠার মিছিল।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশে যাতে আর কখনোই ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচার ফিরে আসতে না পারে, সে জন্য প্রতিটি নাগরিকের সরাসরি ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার সক্ষমতা অর্জন জরুরি। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার থেকে কেন্দ্রীয় সরকার পর্যন্ত জনপ্রতিনিধি হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জনগণের ভোটের প্রতি যতক্ষণ মুখাপেক্ষী করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত জনগণ গণতন্ত্রের সুফল পাবে না। এমনকি স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশেও স্বল্প আয়ের মানুষকে বাজার সিন্ডিকেটের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা অসম্ভব। যদি না মানুষের সরাসরি ভোটের অধিকার আমরা নিশ্চিত করতে পারি।

সভাপতির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার দিন, ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশকে আধিপত্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করার দিন। দীর্ঘ ১৭ বছর আমরা লড়াই করেছি, সংগ্রাম করেছি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এই ১৭ বছরে আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস করে দিয়েছিল। বাংলাদেশকে একটা লুটপাটের রাজত্ব বানিয়ে একে মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। শেখ হাসিনা তার পরিবার, তার সহকর্মীদের নিয়ে এ দেশকে লুটপাট করেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার দোসররা দেশের সর্বত্র ঘাপটি মেরে বসে আছেন। তাদের বিরুদ্ধে সর্তক থাকতে হবে।

শোভাযাত্রায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, সিনিয়র নেতা মোহাম্মদ শাহজাহান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, মজিবুর রহমান সারোয়ার, খায়রুল কবির খোকন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, আবদুস সালাম আজাদ, রশিদুজ্জামান মিল্লাহ, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, রফিকুল ইসলাম, সাইফুল আলম নিরব, রাকিবুল ইসলাম বকুল, নিলোফার চৌধুরী মনি, তাইফুল ইসলাম টিপু, রফিকুল আলম মজনু, আমিনুল হক, এম মোনায়েম মুন্না, নরুল ইসলাম নয়ন, এসএম জিলানি, রাজীব আহসান, হাসান জাফির তুহিন, রাকিকুল ইসলাম রাকিব, নাছির উদ্দিন নাছির ও নিপুণ রায় চৌধুরীসহ কেন্দ্রীয় এবং অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বিএনপি মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা একটি খোলা ট্রাকে এই মিছিলে অংশ নেন। ঢাকা মহানগরের সব ওয়ার্ডসহ মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নরসিংদী ও আশপাশের জেলাগুলো থেকে বাসে করে নেতা-কর্মীরা শোভাযাত্রায় অংশ নেন। রাজধানী ছাড়াও বিভাগীয় শহরগুলোতেও একযোগে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।

প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার ছিল ৭ নভেম্বর। দিনটি ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করে বিএনপি। দিবসটি উপলক্ষে আলোচনা সভা ও শোভাযাত্রাসহ ১০ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটি।

উল্লেখ্য, রাজধানী ছাড়াও বিভাগীয় শহরগুলোতে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার এই কর্মসূচি একযোগে আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া গত ৭ নভেম্বর বিএনপির নেতাকর্মীদের নিয়ে বিএনপি মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির সদস্যরা সকালে শেরেবাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ওই দিন বিকালে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) শিল্পীরা এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।