ঢাকা , সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫, ১০ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

চলতি বর্ষায়ও ভাঙন আতঙ্ক বাঁধের কাজ শেষ করার দাবি

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি: পদ্মার ভাঙনে দুই দশক আগে বসতবাড়ি, জমি হারিয়েছেন কাজী বাবুল। এখন মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার গাওদিয়া গ্রামের যেখানে তাঁর বসতি, সেখান থেকে পদ্মা নদীর দূরত্ব মাত্র ২০০ মিটার। নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেতে পদ্মা সেতুর ভাটির মুন্সীগঞ্জ প্রান্তের বাম তীর সংরক্ষণ প্রকল্প শেষ হয়েছে ৬০ শতাংশ। সেটি দ্রুত শেষ হলে শান্তিতে ঘুমাতে পারতেন বলে মন্তব্য করেন বাবুল।
তাঁর মতো পরিস্থিতিতে আছেন একই উপজেলার কনকসার খালের মুখে পদ্মতীরের বাসিন্দা গোলাম মোস্তফার। সম্প্রতি তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমার বাড়ি থেকে পশ্চিমে ৫০০ মিটার এলাকা স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের বাইরে। তাই শঙ্কায় আছি। গত বছর ঢেউয়ের আঘাতে অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমাদের এখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ হলে নিশ্চিন্ত হতাম।’
মুন্সীগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের অক্টোবরে শুরু হয় এই প্রকল্পের কাজ। যার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের অক্টোবরে। শুরুতে ৯ দশমিক ১ কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য বরাদ্দ হয় ৪৪৬ কোটি টাকা। পরে বাঁধ নির্মাণের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে ১৩ দশমিক ৭২ কিলোমিটার করা হয়। অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয় ৪৭০ টাকা। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে আবার বরাদ্দ বাড়ানো হয়। এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির জন্য সরকার বরাদ্দ দিয়েছে ৫২৭ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
১৩ দশমিক ৭২ কিলোমিটার বাঁধটি লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া থেকে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার দিঘিরপাড় পর্যন্ত হওয়ার কথা। কিন্তু স্থায়ী রক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজে ধীরগতির কারণে পদ্মাতীরের লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বাসিন্দারা দুশ্চিন্তায় আছেন।
বিগত আড়াই দশকে শুধু লৌহজং উপজেলাতেই প্রায় ৪০টি গ্রাম পদ্মায় বিলীন হয়েছে। ভিটেমাটি, জমি হারিয়েছে ২০ হাজার পরিবার। উপজেলার কলমা, গাঁওদিয়া, বেজগাঁও, হলদিয়া, খিদিরপাড়া, লৌহজং-তেউটিয়া, কনকসার, কুমারভোগ ও মেদিনীমণ্ডল ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। বাকি এলাকাও ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে।
সরেজমিন জানা গেছে, প্রতিবছরই টঙ্গিবাড়ী উপজেলার হাসাইল-বরী, পাঁচগাঁও, কামারখাড়া ও দিঘীরপাড় ইউনিয়নে ভাঙন দেখা দেয়। এই চার ইউনিয়নেই বিলীন হয়েছে ২৪টি গ্রাম। এগুলো হলো পাঁচনখোলা, বিধুয়াইল, বানারী, নোয়াদ্দা, নগরজোয়ার, বাঘেরপাড়, বিদগাঁও, মান্দ্রা, আকিগাঁও, ষোলপড়ান, সাতক, মধ্য হাসাইল, ইসলামপুর, পূর্ব হাসাইল, গারুগাঁওগ্রাম, চিত্রকরা, দশোত্তোর, বাঘবাড়ি, কান্দারবাড়ী, সরিষাবন, হাইয়ারপাড়, দিঘিরপাড় ও চৌষার।

টঙ্গিবাড়ীর দিঘীরপাড় বাজারে পদ্মার ভাঙনের শিকার অনিল মণ্ডলের পরিবার হতদরিদ্র। পেশায় তারা বংশপরম্পরায় কামার। ১৩ আগস্ট সেখানে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নদীর তীরেই আমাগো দোকান ছিল। আইজকা নদীতে ভাইঙা নিল। সময়মতো বান্দের কাজ (বাঁধের) কাজ শেষ হইলে এমুন অইত না। অনে (এখন) কই কোথায় দোকানঘর করমু? আর কী কইরা সংসার চলামু?’
একই আক্ষেপ কালু মণ্ডল, সুনীল মণ্ডল, আলমাছ বেপারি ও অলি বেপারির। আলমাছ ও অলি সহোদর। তারা জানিয়েছেন, ৯ বছর আগে নিজেদের সবকিছু বিক্রি করে ১২ লাখ টাকায় দুটি দোকান কিনে ব্যবসা করছিলেন। এর আয়েই দুই ভাইয়ের ১৩ সদস্যের সংসার চলছিল। এর মধ্যে তাদের দোকান ভাঙনের কবলে পড়েছে। বাধ্য হয়ে দোকানের মালপত্র, টিন, বেড়া সরিয়ে নিয়েছেন।
১২ আগস্ট রাতে দিঘীরপাড় বাজারে দুটি দোকানঘর পদ্মায় বিলীন হয়। ১৩ আগস্ট তলিয়ে যায় আরও ছয়টি দোকান। গতকাল শনিবার স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দিঘীরপাড় ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১০টি বসতঘর পদ্মায় বিলীন হয়েছে। ওই গ্রামে এখনও ভাঙন চলছে।
লৌহজংয়ে ইউএনও মো. নেছার উদ্দিনের ভাষ্য, নদীতে পানির প্রবল চাপ। বাতাস ও ঢেউয়ের কারণে আগে ফেলা জিও ব্যাগের অনেকগুলোই সরে গেছে। ফলে নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। টঙ্গিবাড়ীর ইউএনও মো. মোস্তাফিজুর রহমানও একই তথ্য জানিয়ে বলেন, বর্তমানে ভাঙন প্রতিরোধে পাউবোর কার্যক্রম চলছে।
পাউবোর তথ্যমতে, পদ্মা নদীর বাম তীরে ১৩ দশমিক ৭২ শতাংশ কিলোমিটার তীর এলাকায় স্থায়ী ও সতর্কতামূলক বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ ৯ দশমিক ১০০ কিলোমিটারে। বাকি ৪ দশমিক ৬২০ কিলোমিটার অংশে সতর্কতামূলক প্রতিরক্ষা কাজ (ভাঙনপ্রবণ এলাকায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা) চলছে।
২৬টি প্যাকেজের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ চলছে বলে জানান পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী (টঙ্গিবাড়ী পওর শাখা) মো. আশিক সারোয়ার। তিনি বলেন, দিঘীরপাড় বাজারে পূর্বদিকে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছিল। চলতি বর্ষা মৌসুমে আবারও ভাঙন দেখা দিয়েছে। তাই ভাঙনরোধে আরও জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। এখন তারা ব্লক ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

আপলোডকারীর তথ্য

Rudra Kantho24

জনপ্রিয় সংবাদ

আমরা সচেতন হলে দূর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব: ডিসি

চলতি বর্ষায়ও ভাঙন আতঙ্ক বাঁধের কাজ শেষ করার দাবি

আপডেট সময় ০২:৪৮:১৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি: পদ্মার ভাঙনে দুই দশক আগে বসতবাড়ি, জমি হারিয়েছেন কাজী বাবুল। এখন মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার গাওদিয়া গ্রামের যেখানে তাঁর বসতি, সেখান থেকে পদ্মা নদীর দূরত্ব মাত্র ২০০ মিটার। নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেতে পদ্মা সেতুর ভাটির মুন্সীগঞ্জ প্রান্তের বাম তীর সংরক্ষণ প্রকল্প শেষ হয়েছে ৬০ শতাংশ। সেটি দ্রুত শেষ হলে শান্তিতে ঘুমাতে পারতেন বলে মন্তব্য করেন বাবুল।
তাঁর মতো পরিস্থিতিতে আছেন একই উপজেলার কনকসার খালের মুখে পদ্মতীরের বাসিন্দা গোলাম মোস্তফার। সম্প্রতি তিনি সমকালকে বলেন, ‘আমার বাড়ি থেকে পশ্চিমে ৫০০ মিটার এলাকা স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের বাইরে। তাই শঙ্কায় আছি। গত বছর ঢেউয়ের আঘাতে অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমাদের এখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ হলে নিশ্চিন্ত হতাম।’
মুন্সীগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের অক্টোবরে শুরু হয় এই প্রকল্পের কাজ। যার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের অক্টোবরে। শুরুতে ৯ দশমিক ১ কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য বরাদ্দ হয় ৪৪৬ কোটি টাকা। পরে বাঁধ নির্মাণের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে ১৩ দশমিক ৭২ কিলোমিটার করা হয়। অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয় ৪৭০ টাকা। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে আবার বরাদ্দ বাড়ানো হয়। এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির জন্য সরকার বরাদ্দ দিয়েছে ৫২৭ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
১৩ দশমিক ৭২ কিলোমিটার বাঁধটি লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়া থেকে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার দিঘিরপাড় পর্যন্ত হওয়ার কথা। কিন্তু স্থায়ী রক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজে ধীরগতির কারণে পদ্মাতীরের লৌহজং ও টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বাসিন্দারা দুশ্চিন্তায় আছেন।
বিগত আড়াই দশকে শুধু লৌহজং উপজেলাতেই প্রায় ৪০টি গ্রাম পদ্মায় বিলীন হয়েছে। ভিটেমাটি, জমি হারিয়েছে ২০ হাজার পরিবার। উপজেলার কলমা, গাঁওদিয়া, বেজগাঁও, হলদিয়া, খিদিরপাড়া, লৌহজং-তেউটিয়া, কনকসার, কুমারভোগ ও মেদিনীমণ্ডল ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। বাকি এলাকাও ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে।
সরেজমিন জানা গেছে, প্রতিবছরই টঙ্গিবাড়ী উপজেলার হাসাইল-বরী, পাঁচগাঁও, কামারখাড়া ও দিঘীরপাড় ইউনিয়নে ভাঙন দেখা দেয়। এই চার ইউনিয়নেই বিলীন হয়েছে ২৪টি গ্রাম। এগুলো হলো পাঁচনখোলা, বিধুয়াইল, বানারী, নোয়াদ্দা, নগরজোয়ার, বাঘেরপাড়, বিদগাঁও, মান্দ্রা, আকিগাঁও, ষোলপড়ান, সাতক, মধ্য হাসাইল, ইসলামপুর, পূর্ব হাসাইল, গারুগাঁওগ্রাম, চিত্রকরা, দশোত্তোর, বাঘবাড়ি, কান্দারবাড়ী, সরিষাবন, হাইয়ারপাড়, দিঘিরপাড় ও চৌষার।

টঙ্গিবাড়ীর দিঘীরপাড় বাজারে পদ্মার ভাঙনের শিকার অনিল মণ্ডলের পরিবার হতদরিদ্র। পেশায় তারা বংশপরম্পরায় কামার। ১৩ আগস্ট সেখানে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নদীর তীরেই আমাগো দোকান ছিল। আইজকা নদীতে ভাইঙা নিল। সময়মতো বান্দের কাজ (বাঁধের) কাজ শেষ হইলে এমুন অইত না। অনে (এখন) কই কোথায় দোকানঘর করমু? আর কী কইরা সংসার চলামু?’
একই আক্ষেপ কালু মণ্ডল, সুনীল মণ্ডল, আলমাছ বেপারি ও অলি বেপারির। আলমাছ ও অলি সহোদর। তারা জানিয়েছেন, ৯ বছর আগে নিজেদের সবকিছু বিক্রি করে ১২ লাখ টাকায় দুটি দোকান কিনে ব্যবসা করছিলেন। এর আয়েই দুই ভাইয়ের ১৩ সদস্যের সংসার চলছিল। এর মধ্যে তাদের দোকান ভাঙনের কবলে পড়েছে। বাধ্য হয়ে দোকানের মালপত্র, টিন, বেড়া সরিয়ে নিয়েছেন।
১২ আগস্ট রাতে দিঘীরপাড় বাজারে দুটি দোকানঘর পদ্মায় বিলীন হয়। ১৩ আগস্ট তলিয়ে যায় আরও ছয়টি দোকান। গতকাল শনিবার স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দিঘীরপাড় ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ১০টি বসতঘর পদ্মায় বিলীন হয়েছে। ওই গ্রামে এখনও ভাঙন চলছে।
লৌহজংয়ে ইউএনও মো. নেছার উদ্দিনের ভাষ্য, নদীতে পানির প্রবল চাপ। বাতাস ও ঢেউয়ের কারণে আগে ফেলা জিও ব্যাগের অনেকগুলোই সরে গেছে। ফলে নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। টঙ্গিবাড়ীর ইউএনও মো. মোস্তাফিজুর রহমানও একই তথ্য জানিয়ে বলেন, বর্তমানে ভাঙন প্রতিরোধে পাউবোর কার্যক্রম চলছে।
পাউবোর তথ্যমতে, পদ্মা নদীর বাম তীরে ১৩ দশমিক ৭২ শতাংশ কিলোমিটার তীর এলাকায় স্থায়ী ও সতর্কতামূলক বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজ ৯ দশমিক ১০০ কিলোমিটারে। বাকি ৪ দশমিক ৬২০ কিলোমিটার অংশে সতর্কতামূলক প্রতিরক্ষা কাজ (ভাঙনপ্রবণ এলাকায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা) চলছে।
২৬টি প্যাকেজের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ চলছে বলে জানান পাউবোর উপসহকারী প্রকৌশলী (টঙ্গিবাড়ী পওর শাখা) মো. আশিক সারোয়ার। তিনি বলেন, দিঘীরপাড় বাজারে পূর্বদিকে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছিল। চলতি বর্ষা মৌসুমে আবারও ভাঙন দেখা দিয়েছে। তাই ভাঙনরোধে আরও জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। এখন তারা ব্লক ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।