৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারি সরকারের পতনের পর দেশের করুণ ও বীভৎস চিত্র এখন জাতির সামনে এসেছে। জীবনে কেউ কখনো শোনেনি এমন একটি পরিভাষা আয়নাঘর। নিকৃষ্টতম কারাপ্রকোষ্ট আয়নাঘরের প্রবর্তক শেখ হাসিনা। বছরের পর বছর বিরুদ্ধ মতের লোকের বন্দি করে রাখা হয়েছে। কাউকে গুম করা হয়েছে। কাউকে অবর্ণনীয় নির্যাতনের খাঁচায় পিষ্ট করা হয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে, প্রতিটি বড় প্রতিষ্ঠানেই নাকি এ ধরনের নিষ্ঠুর নির্যাতন প্রকোষ্ট চালু ছিল।
অর্থনৈতিকভাবে দেশ বলতে গেলে ফতুর, দেউলিয়া। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক-শেয়ার বাজার লুট, অর্থ পাচার, আর ঘুষ, দুর্নীতির অবিশ্বাস্য সয়লাবে তছনছ হয়ে গেছে সব, অথচ প্রচার করা হয়েছে উন্নয়নের ভেলায় দেশ নিরুদ্দেশ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে। সবচেয়ে মারাত্মক অবস্থা হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থায়। স্কুল, কলেজ, মাদরাসার শিক্ষা কারিকুলামে এমনকিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা গোটা জাতিকে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধর্মহীন, নৈতিকতাবর্জিত, দেবদেবীর পুজারী ও ভারতীয় সংস্কৃতিতে আসক্ত করে গড়ে তুলত। পরীক্ষা ব্যবস্থা তুলে দিয়ে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের পরিকল্পনার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল, এ জাতি যেন কোনো দিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। কেউ কল্পনাও করতে পারেনি শেখ হাসিনার অক্টোপাসে আওয়ামী লীগের একটানা সাড়ে পনের বছরের স্বৈরশাসনের কোনদিন পতন ঘটবে, জাতির বুকের উপর থেকে জগদ্দল পাথর সরে যাবে। অসহায় মানুষের সামনে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। এ অবস্থায় অবিশ্বাস্যভাবে ঘটে যায় ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লব।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ঘোষণা দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার যে শিক্ষানীতি চালু করেছিল, যার বিরুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণ ক্ষুব্ধ, তা বাতিল করা হবে। এখন শিক্ষা ব্যবস্থা চলবে ১৫ বছর আগের ধারায়। প্রশ্ন হলো, শিক্ষা ব্যবস্থা ১৫ বছর আগের ধারায় ফিরে যাওয়া কী আদৌ সম্ভব হবে? অথবা ১৫ বছর আগে যে শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো তা কী ত্রুটিহীন ছিল? সেই প্রশ্নে বা তর্কে না গিয়ে এখন সহজভাবে সবার জিজ্ঞাসা হচ্ছে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হওয়া চাই। সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার মধ্যে জাতির উজ্জ্বল বা অন্ধকার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। কারণ, শিক্ষাই জাতির মেরুদ-Ñ এই আপ্ত বাক্যটি সর্বাংশে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
আমাদের সহজ ও স্পষ্ট বক্তব্য হল: আমাদের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হওয়া চাই, যার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য থাকবে এরূপ:
আত্মপরিচয়:
আমাদের ছেলে-মেয়েরা যাতে আত্মপরিচয় নিয়ে বেড়ে ও গড়ে উঠতে পারে, সেই উপাদান থাকতে হবে শিক্ষা ব্যবস্থায়। আত্মপরিচয়ের জন্য প্রধানত জানতে হবে আমরা প্রাণি বটে, তবে অন্যান্য প্রাণির মতো নই। আমাদের নাম মানুষ। মানুষ হিসেবে আমাদের চরিত্র আলাদা, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে এবং জগতজয়ের সম্ভাবনা আমাদের মাঝে সুপ্ত আছে।
খ) আত্মপরিচয়কে ঋদ্ধ করার জন্য আমাদের জানতে হবে আমাদের পারিপার্শ্বিকতা, অন্য মানুষের সাথে সম্পর্কের ধরন। জানতে হবে আমার সমাজকে, জাতিকে এবং দেশকে।
গ) আমাদের জানতে হবে, জীবনের শেষ গন্তব্য কী? আমরা কোত্থেকে এসেছি? কী জন্য এসেছি? কোথায় যাব? কী নিয়ে যাব? পৃথিবীতে নিজের অবস্থান অর্থবহ করার জন্য এখানে কী রেখে যাবো।
২. আত্মবিকাশ
শিক্ষা ব্যবস্থার দ্বিতীয় যে বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে, তা হলো, আমার ভিতরে যে অযুত সম্ভাবনা, প্রতিভা, মেধা লুকিয়ে আছে তার বিকাশ কীভাবে করবো। মাওলানা রুমী বলেছেন, মানুষ হলো গোটা সৃষ্টি জগতের নির্যাস। মানুষকে বিকশিত করলে এই বিশাল জগত পাওয়া যাবে। বিশাল জগতকে সংকোচিত করলে একটি মানুষের রূপ নেবে। আমাদের ধর্মে বলা হয়েছে, মানুষ খলিফা বা পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। প্রতিনিধিত্ব করার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও প্রতিভা প্রত্যেকের মধ্যে সুপ্ত রাখা হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় সেগুলোর যতœ ও পরিচর্যার ব্যবস্থা থাকতে হবে। যদি পরিচর্যা না করা হয়, তবে মানুষের অযুত সম্ভাবনা ও প্রতিভা নষ্ট হয়ে যাবে। কাজেই মানুষের নিজের মেধা ও প্রতিভা সমাজ ও দেশের সামনে মেলে ধরার ব্যবস্থা থাকতে হবে শিক্ষা ব্যবস্থায়।
৩. দায়িত্বশীলতা
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, দায়িত্বশীলতা জাগ্রত করা। পৃথিবীতে প্রত্যেক প্রাণী নির্ধারিত সময় জীবনযাপন করে। তখন শুধু নিজের ও স্বজনদের খাওয়া-পরা ও সুখ-শান্তির জন্য ব্যস্ততায় কাটায়, যাকে এক কথায় স্বার্থপরতা ও স্বজনপ্রীতি বলা যায়। কিন্তু মানুষ হতে হলে অন্য মানুষের, অন্যান্য প্রাণির জন্য কাজ করতে হবে। ইসলাম এ দায়িত্ব অপর্ণ করেছে প্রতিটি মুসলমানের উপর। বলেছে, তোমাদেরকে পাঠানো হয়েছে, মাঠে বের করে দেওয়া হয়েছে মানব জাতির কল্যাণ সাধনের জন্য। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১১০)। অন্য কথায় সৃষ্টির সেবার জন্য, যাকে বলে খেদমতে খালক। শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আগামী প্রজন্মকে সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
৪. জাতীয় সম্পদ ও সম্ভাবনার বিশ্বায়ন
চতুর্থ যে বৈশিষ্ট্যের কথা আমরা চিন্তা করতে পারি তাহলো, প্রত্যেক অঞ্চলের, প্রত্যেক জাতির এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো অন্যত্র নেই। শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন পরিকল্পনা থাকতে হবে, যাতে আমাদের দেশে বিদ্যমান এ জাতীয় উপাদান, মানব সম্পদ, প্রাকৃতিক, খনিজ ও অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতগুলোকে চিহ্নিত ও বিশ্বমাঝে উপস্থাপনের উপযোগী করতে পারি। আমরা আমাদের বন সম্পদ, কৃষিজ পণ্য, খনিজ সম্পদ ও মানব সম্পদের উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও বাজারজাত করণের সঠিক কর্মকৌশল গ্রহণ করতে পারিনি। শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন মেকানিজম থাকতে হবে, যাতে দেশ আত্মনির্র্ভরশীল হয়ে বিশ্বাবাসীকে কিছু উপহার দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে।
একটি ছোট অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। ইরান থেকে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদল এসেছিলো বাংলাদেশ সফরে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তৎকালীন ডিজির সাথে সাক্ষাতকালে প্রতিনিধি দলের প্রধান জানতে চাইলেন, আপনাদের দেশে মুসলমানদের এত সংখ্যা, এতো মসজিদ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস, ইরানের ও ফারসির সাথে আপনাদের আত্মীয়তার কথা আমরা জানি এবং এজন্য গর্বিত। আমাদের জিজ্ঞাসা, ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে এমন কিছু কাজ কি এখানে হয়েছে, যা বহির্বিশ্বে উপস্থাপন করা যেতে পারে বা অন্যান্য মুসলিম দেশ তার দ্বারা লাভবান হতে পারে ও অনুকরণ করতে পারে? আমি তখন দোভাষীর ভূমিকা পালন করেছিলাম। আমার যতদূর মনে পড়ে, ডিজি মহোদয় সেদিন সন্তোষজনক কোনো জবাব দিতে পারেননি। বস্তুত স্বতন্ত্র দেশ ও জাতি হিসেবে বিশ্ব সভায় উপস্থাপনের মতো আইডিয়া, সাহিত্য বা শিল্পকর্ম কিংবা অন্যকিছু উদ্ভাবনের মানসিকতা গড়ে তোলার ব্যবস্থা থাকতে হবে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের সন্তানদের জন্য।
শিক্ষাব্যবস্থার উপরি কাঠামো কেমন হবে
একটি জিজ্ঞাসা হলো, দেশে বর্তমানে যে শিক্ষা ব্যবস্থা বা কাঠামো বিদ্যমান, তা দিয়ে কি উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে? নাকি সবকিছু ভেঙ্গে নতুনভাবে গড়তে হবে? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল একটি ধারা হলো ইংরেজ আমলে প্রবর্তিত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনারেল শিক্ষা। অপরদিকে আছে মাদরাসা শিক্ষা। এই দুই ধারার মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন শাখা-প্রশাখা রয়েছে। যেমন- ডাক্তারী, কৃষি, ক্যাডেট, ইংলিশ মিডিয়াম প্রভৃতি এবং মাদরাসায় কওমী, আলিয়া, হেফজ, নূরানী ইত্যাদি।
একটি মুখরোচক শ্লোগান হচ্ছে, সবকিছু নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। জেনারেল ও মাদরাসা একাকার করে একমুখী বা সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এখানে জেনারেল শিক্ষার ইসলামায়নের কথা বলা হয় না; বরং মাদরাসা শিক্ষাকে জেনারেল শিক্ষার সাথে একীভূত করার কথা বলা হয়। আমি বিনয়ের সাথে এমন চিন্তার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে চাই। কারণ, মুখরোচক কথাটি রাজনৈতিক শ্লোগান হিসেবে সুন্দর শুনালেও তা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব এবং তার প্রভাব হবে ধ্বংসাত্মক। মাদরাসা শিক্ষাকে জেনারেল শিক্ষার পেটে ঢুকিয়ে দেওয়ার ভয়াবহ পরিণতির অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করেছি অতীতের নিউস্কিম মাদরাসা শিক্ষার ভাগ্যবিড়ম্বনা হতে। স্কুল শিক্ষাকে মাদরাসার শিক্ষায় রূপান্তর করার কথা কেউ মানবে না। আমরাও চিন্তা করি না। তাহলে করণীয় কী?
আমার ক্ষুদ্র মত হলো, শিক্ষা ব্যবস্থার যে কাঠামো ও বিভাজন বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে তার সামান্য সংস্কার করলেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন হলো, শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো সংস্কারের চেয়ে আমাদের মন-মানসিকতার সংস্কার। যারা শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়ায় কাজ করছেন, তাদের মনস্থির করতে হবে যে, আমরা কি বিদেশিদের চাপিয়ে দেয়া ছক আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় হুবহু চালু করবো, নাকি দেশীয় চাহিদা, অতীত ঐতিহ্য ও জাতীয় চেতনাকে শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিফলিত করব এবং সে অনুযায়ী আমাদের সন্তানদের গড়ে তুলবো।
এক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন আমাদের ধর্মীয় চিন্তায় পরিবর্তন সাধনের। একটি ছোট্ট উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিগত ১৫ বছরের স্বৈরাচারি সরকারের আমলের শেষের দিকে স্কুলের নবম-দশম শ্রেণি থেকে ইসলামিয়াতের ১০০ নম্বরের পরীক্ষা তুলে দেওয়ার জন্য যখন গোপনে তোড়জোড় চলছে, তখন কওমী ঘরাণার একজন শীর্ষ নেতাকে একান্ত আলাপচারিতায় বললাম, আমরা তো বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলছি, আন্দোলন করছি; কিন্তু খুব গোপনে ও কৌশলে স্কুলের নবম-দশম শ্রেণি থেকে ১০০ নম্বরের বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষা তুলে দেওয়ার জন্য গভীর ষড়যন্ত্র এখন কার্যকর হওয়ার পথে রয়েছে। মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী শতকরা ৯০ জন ছেলেমেয়ে স্কুলে পড়ে। মাত্র ১০ জন ছাত্রছাত্রী মাদরাসায় দাখিলে পড়ে।
স্কুলে যারা পড়ে তাদের জন্য নিজের ধর্মকর্ম আচার-অনুষ্ঠান ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার সুযোগ বা বাধ্যবাধকতা এই ১০০ নম্বরের পরীক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই সুযোগ কেড়ে নেওয়া হলে আগামী প্রজন্ম নাস্তিক হয়ে বের হবে। কাজেই আপনি এ ব্যাপারে একটি বলিষ্ঠ বক্তব্য দিলে ভালো হবে। আমার আবদারের জবাবে তিনি যা বলেছিলেন, তা নিয়ে এখনো চিন্তা করি, একজন জাতীয় পর্যায়ের ধর্মীয় নেতার দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে এমন হতে পারে। আমি অবাক হয়ে শুনলাম, তিনি বললেন : আসলে হাফেজ্জি হুজুরই ঠিক কথা বলেছিলেন, আমিও যেখানে যাই এই কথাই বলি, আমাদেরকে গ্রামে গ্রামে পাড়ায় মহল্লায় নূরানী মাদরাসা চালু করতে হবে।
নূরানী মাদরাসা তো আমিও চাই, সবাই চায়। কিন্তু নূরানী মাদরাসা তো মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। এরপরের শিক্ষা ব্যবস্থা কী হবে তা নিয়ে চিন্তা করার কি কিছুই নেই? শেষ পর্যন্ত যা বুঝা গেল, আমাদের অধিকাংশ শীর্ষ ওলামা, ইসলামী চিন্তাবিদ একমাত্র মসজিদ, মাদরাসার মধ্যে ইসলামচর্চা সীমাবদ্ধ বলে ভাবেন। শেষ পর্যন্ত তিনি এ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো বক্তৃতা বিবৃতি দিলেন না। ফল তো আমরা আপনারা দেখলাম যে, জেনারেল শিক্ষা থেকে ইসলাম চিরতরে বিদায় দেয়ার জন্য শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাহেব যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, দীপু মনি তার চূড়ান্ত রূপ দেন আর নওফেল সাহেব তার পিতার জায়গায় দাঁড়িয়ে বলেই ফেললেন, আমি যদি জয় শ্রীরাম শ্লোগান দেই, আমার ঈমানের সাথে বিরোধ কোথায়?
বলতে চাচ্ছি, দুঃখজনকভাবে আমাদের ধর্মীয় মহল মনে করেন যে, ইসলামী শিক্ষা বলতে একমাত্র মাদরাসা শিক্ষাকেই বুঝায়। জেনারেল শিক্ষা ইসলামের বাইরে, নিছক দুনিয়াদারির শিক্ষা। বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে। এখানে সংক্ষেপে বলতে চাই। মাদরাসা শিক্ষা যেমন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, তেমনি জেনারেল শিক্ষা ব্যবস্থাও আমাদেরই শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শেষোক্তটি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান ধারা। এই শিক্ষা যেভাবেই চালু হোক না কেন, উভয় ধারা এখন সমাজের বাস্তবতা। বাস্তবতাকে অস্বীকার করে কেউ পথ চলতে বা বেঁচে থাকতে পারে না।
জেনারেল শিক্ষা ব্যবস্থা ও ইসলাম
প্রশ্ন উঠতে পারে, ইসলামী শিক্ষা বলতে তো কুরআন, হাদিস, ফিকাহ, ইসলামের ইতিহাস, এগুলোই বুঝি। এখন জেনারেল শিক্ষায় প্রচলিত বিচিত্র সাবজেক্ট কীভাবে ইসলামী শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে কিংবা অন্য কথায় শিক্ষার ইসলামায়ন আদৌ সম্ভব হবে কিনা। এর সহজ উত্তর হলো, কুরআন ও হাদিসই আমাদের বলে দিয়েছে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে প্রচলিত সকল বিভাগ ও ডিসিপ্লিন ইসলামী শিক্ষার আওতাভুক্ত হতে পারে। এর কোনো একটাকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। কুরআন মজিদের এক একটি বচনকে আমরা আয়াত বলি। আয়াত শব্দের অর্থ নিদর্শন। তার মানে কুরআন মজিদের প্রত্যেকটি আয়াত আল্লাহকে চেনার, ইসলামের সত্যতা প্রমাণের নিদর্শন। লক্ষ করুন, এই আয়াত কুরআন মজিদের প্রতিটি বচনের ক্ষেত্রে যেমন ব্যবহৃত হয়েছে, তেমনি সৃষ্টিজগতের প্রতিটি প্রপঞ্চকে কুরআনে আয়াত বলা হয়েছে। প্রত্যেকটি একেকটি নিদর্শন। এই আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা অনুধ্যানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেগুলো ভোগ-ব্যবহারের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। যারা এই কাজটি করেন আল্লাহ পাক তাদের উলুল আলবাব (প্রজ্ঞাবান), ইয়া’কিলুন (বুদ্ধিদীপ্ত) আলেম (জ্ঞানী) হিসেবে প্রশংসা করেছেন। কুরআন মজিদে আলেমদের পরিচয়বাচক একটি কথা হলো- ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলেম বা জ্ঞানীরাই তাকে ভয় করে।’ (চলবে)
লেখক: পরিচালক, বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা