ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অলস পড়ে আছে বিদ্যুৎকেন্দ্র

প্রকৃতিতে শরৎকাল চলছে। গ্রাম-গঞ্জে ইতিমধ্যে শীতের আবহ পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু লোডশেডিং সে তুলনায় অনেক বেশি। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্র বলছে, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের একটি টার্মিনাল (সামিটের মালিকানাধীন) তিন মাস ধরে বন্ধ। এতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ছে না। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন কমেছে। বিল বকেয়া থাকায় আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ কমেছে ৫০০ মেগাওয়াট।

বেসরকারি খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও সর্বোচ্চ চাহিদায় উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কারণ তারাও অনেক টাকা পাবে। তাই ঘাটতি পূরণে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়।

কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল গত ২৭ মে থেকে বন্ধ। এতে এলএনজি সরবরাহ দাঁড়িয়েছে দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট। সার্বিকভাবে দিনে এখন গ্যাস সরবরাহ নেমে এসেছে ২৬০ কোটি ঘনফুটে। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমে দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটি ঘনফুট। আড়াই মাস আগেও গ্যাস থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হতো। এখন হচ্ছে ৫ হাজার মেগাওয়াট।

ঢাকা এবং বড় শহরগুলোতে লোডশেডিং তুলনামূলক কম হলেও গ্রামাঞ্চলে এবং ছোট শহরগুলোতে ব্যাপক লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক, রাইস মিলের শ্রমিকসহ বিভিন্ন খাতের ক্ষুদ্র আয়ের মানুষের আয় কমেছে।

গবাদিপশুর খামারিরাও বড় ধরনের আর্থিক সংকটের আশঙ্কা করছেন লোডশেডিংয়ের কারণে।ইতিপূর্বে জ্বালানি নিশ্চিত না করেই একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। চাহিদাকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ফলে প্রতি বছর বড় সময় অলস বসিয়ে রাখতে হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। দিতে হয়েছে অলস কেন্দ্রের ভাড়া। খরচের চাপ সামলাতে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেড়েছে, সরকারের দায় বেড়েছে। অথচ তিন বছর ধরে গরম বাড়লেই লোডশেডিংয়ে ভুগতে হচ্ছে মানুষকে। কারণ বিদ্যুতের বড় একটা অংশই আমদানিনির্ভর।

দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে বিপুল পরিমাণ পাওনা বকেয়া পড়েছে ভারতীয় কোম্পানি আদানি গ্রুপের। এ বিল পরিশোধে এরই মধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারকে সতর্কবার্তা দিয়েছে আদানি। দেশের বিদ্যুৎ বিভাগের সবচেয়ে বড় সংকট হলো দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে বিপুল পরিমাণ পাওনা বকেয়া পড়েছে ভারতীয় কোম্পানি আদানি গ্রুপের।

আদানি ছাড়াও ভারত থেকে দেশটির সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশে দ্বিপক্ষীয় বিদ্যুৎ বাণিজ্য চুক্তির আওতায় আনা হচ্ছে আরও ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সেখানেও বকেয়া পড়ছে। এ বিপুল পরিমাণ বকেয়ার কারণে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন, এমনকি বন্ধ হয়ে পড়ারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদিও বিপিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, দেশটি থেকে সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে জরুরি ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি মোকাবিলার মতো সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশে আছে। যদিও আশঙ্কা রয়েছে এগুলো চালানোর জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান করা নিয়ে। এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে জ্বালানি সংকটের কারণে বিপিডিবি তা তাৎক্ষণিক মোকাবিলা করতে পারবে কি না সে বিষয়ে বড় ধরনের সংশয় রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের আশপাশে। ভারতের সঙ্গে আমদানি চুক্তি রয়েছে ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াটের (আদানি ও জিটুজি মিলিয়ে), যা চাহিদার ২০ শতাংশের কাছাকাছি। এর মধ্যে আদানি গ্রুপ ও ভারত সরকারের সঙ্গে জিটুজি চুক্তির আওতায় প্রতিবেশী দেশটি মোট ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট আসার কথা। কিন্তু এরই মধ্যে আদানি গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ কোম্পানিটির পাওনা বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতিকে ব্যবসা চালানোর জন্য ‘টেকসই নয়’ বলে মনে করছে আদানি গ্রুপ। বকেয়া বেড়ে যাওয়ায় বিপিডিবিকে জিটুজির আওতায় আনা বিদ্যুতের সরবরাহও কমিয়ে দিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো। বকেয়া পরিশোধ নিয়ে সংকট আরও বাড়লে একপর্যায়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধও হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ ধরনের পরিস্থিতিতেও তাৎক্ষিণক সংকট মোকাবিলায় পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী। তিনি বলেছেন, আকস্মিকভাবে গ্রিড বিপর্যয় ঘটলে কিংবা গ্রিড থেকে বড় কোনো সক্ষমতা আউট হয়ে গেলে তা মোকাবিলার জন্য মোটা দাগে দুটি বিষয় প্রস্তুতি ও পর্যবেক্ষণ থাকতে হয়। এর একটি হলো-যে সক্ষমতার সরবরাহ গ্রিডে কমছে, তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত রাখা। সে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান রাখা। দ্বিতীয়ত, পাওয়ার প্লান্ট নির্দিষ্ট একটি সময়ে রক্ষণাবেক্ষণে নিতে হয়। ফলে গ্রিড ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সবসময়ই হিসাবটাও রাখতে হয়। ফলে কোনো কারণে আমদানি বিদ্যুতের সরবরাহ কমে গেলে সেখানে সরবরাহ করতে হবে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালিয়ে।

বিপিডিবির এক কর্মকর্তা বলেছেন, দেশে জ্বালানি সংকট থাকায় আমদানি বিদ্যুতে নির্ভরতা বেড়েছে। কারণ সেই আমদানির পরিমাণটাও কম নয়। তবে কোনো কারণে সংকট তৈরি হলে জ্বালানি সংকটের যে চিত্র তার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা বা বিকল্প সরবরাহ সক্ষমতা এ মুহূর্তে তৈরি করা নেই। অন্যদিকে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় কলকারখানার উৎপাদনও চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় গ্যাস সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ার কারণে এ সমস্যা হচ্ছে। শুধু ব্যবসার ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য খাতেও গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে, বিশেষ করে সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে।

রূপসায় ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গ্যাসের জন্য চালু করা যাচ্ছে না। ব্যাপক লোডশেডিং থেকে মুক্তি পেতে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বেশি হারে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া শুরু হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০ পাস করা হয়, যা দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত। এ আইনের অধীন দরপত্র ছাড়াই নির্মাণ করা হয় একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রথমে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা যুক্ত হলেও পরে আওয়ামী লীগের নেতারা নিতে থাকেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ভারত থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়। গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা বেড়েছে পাঁচগুণের বেশি, উৎপাদন বেড়েছে ৩ দশমিক ৬ গুণ। আর কেন্দ্রভাড়া বেড়েছে ১৬ গুণ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মূলত বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে এভাবে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এ সময় দেখা গেছে, ৫ হাজার থেকে বেড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াট, যা চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ। যদিও অর্ধেকের মতো সক্ষমতা অলস পড়ে থাকে। পরিশোধ করতে হচ্ছে সক্ষমতার ভাড়া, যা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে পরিচিত।

বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন ক্ষমতা, খরচ কেন বাড়ল ইত্যাদি নিয়ে গত ২৫ আগস্ট বিদ্যুৎ বিভাগে একটি ব্যাখ্যা তুলে ধরেছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ খাতের দুজন ব্যবসায়ী বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকে। এটি হয়েছে মূলত জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ হয় জ্বালানির দাম বাবদ। সেই জ্বালানির দাম বেড়েছে ১৬৩ শতাংশ। আমাদের দেশে যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আছে, সেগুলো চালু করলেও স্বয়ং সম্পূর্ণতা আসতে পারে। সেজন্য জা¦লানি আমদানি করে সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালালে বিদ্যুৎ স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসতে পারে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এটা নিয়ে ভাবতে হবে।

ট্যাগস
জনপ্রিয় সংবাদ

অলস পড়ে আছে বিদ্যুৎকেন্দ্র

আপডেট সময় ০৫:৩৭:৪৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রকৃতিতে শরৎকাল চলছে। গ্রাম-গঞ্জে ইতিমধ্যে শীতের আবহ পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু লোডশেডিং সে তুলনায় অনেক বেশি। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্র বলছে, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের একটি টার্মিনাল (সামিটের মালিকানাধীন) তিন মাস ধরে বন্ধ। এতে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ছে না। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এক হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন কমেছে। বিল বকেয়া থাকায় আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ কমেছে ৫০০ মেগাওয়াট।

বেসরকারি খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও সর্বোচ্চ চাহিদায় উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কারণ তারাও অনেক টাকা পাবে। তাই ঘাটতি পূরণে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়।

কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল গত ২৭ মে থেকে বন্ধ। এতে এলএনজি সরবরাহ দাঁড়িয়েছে দৈনিক ৬০ কোটি ঘনফুট। সার্বিকভাবে দিনে এখন গ্যাস সরবরাহ নেমে এসেছে ২৬০ কোটি ঘনফুটে। বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমে দাঁড়িয়েছে ৮২ কোটি ঘনফুট। আড়াই মাস আগেও গ্যাস থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হতো। এখন হচ্ছে ৫ হাজার মেগাওয়াট।

ঢাকা এবং বড় শহরগুলোতে লোডশেডিং তুলনামূলক কম হলেও গ্রামাঞ্চলে এবং ছোট শহরগুলোতে ব্যাপক লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক, রাইস মিলের শ্রমিকসহ বিভিন্ন খাতের ক্ষুদ্র আয়ের মানুষের আয় কমেছে।

গবাদিপশুর খামারিরাও বড় ধরনের আর্থিক সংকটের আশঙ্কা করছেন লোডশেডিংয়ের কারণে।ইতিপূর্বে জ্বালানি নিশ্চিত না করেই একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। চাহিদাকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ফলে প্রতি বছর বড় সময় অলস বসিয়ে রাখতে হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। দিতে হয়েছে অলস কেন্দ্রের ভাড়া। খরচের চাপ সামলাতে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেড়েছে, সরকারের দায় বেড়েছে। অথচ তিন বছর ধরে গরম বাড়লেই লোডশেডিংয়ে ভুগতে হচ্ছে মানুষকে। কারণ বিদ্যুতের বড় একটা অংশই আমদানিনির্ভর।

দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে বিপুল পরিমাণ পাওনা বকেয়া পড়েছে ভারতীয় কোম্পানি আদানি গ্রুপের। এ বিল পরিশোধে এরই মধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারকে সতর্কবার্তা দিয়েছে আদানি। দেশের বিদ্যুৎ বিভাগের সবচেয়ে বড় সংকট হলো দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে বিপুল পরিমাণ পাওনা বকেয়া পড়েছে ভারতীয় কোম্পানি আদানি গ্রুপের।

আদানি ছাড়াও ভারত থেকে দেশটির সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশে দ্বিপক্ষীয় বিদ্যুৎ বাণিজ্য চুক্তির আওতায় আনা হচ্ছে আরও ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সেখানেও বকেয়া পড়ছে। এ বিপুল পরিমাণ বকেয়ার কারণে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন, এমনকি বন্ধ হয়ে পড়ারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদিও বিপিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, দেশটি থেকে সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে জরুরি ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি মোকাবিলার মতো সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশে আছে। যদিও আশঙ্কা রয়েছে এগুলো চালানোর জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান করা নিয়ে। এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে জ্বালানি সংকটের কারণে বিপিডিবি তা তাৎক্ষণিক মোকাবিলা করতে পারবে কি না সে বিষয়ে বড় ধরনের সংশয় রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের আশপাশে। ভারতের সঙ্গে আমদানি চুক্তি রয়েছে ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াটের (আদানি ও জিটুজি মিলিয়ে), যা চাহিদার ২০ শতাংশের কাছাকাছি। এর মধ্যে আদানি গ্রুপ ও ভারত সরকারের সঙ্গে জিটুজি চুক্তির আওতায় প্রতিবেশী দেশটি মোট ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট আসার কথা। কিন্তু এরই মধ্যে আদানি গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ কোম্পানিটির পাওনা বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতিকে ব্যবসা চালানোর জন্য ‘টেকসই নয়’ বলে মনে করছে আদানি গ্রুপ। বকেয়া বেড়ে যাওয়ায় বিপিডিবিকে জিটুজির আওতায় আনা বিদ্যুতের সরবরাহও কমিয়ে দিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো। বকেয়া পরিশোধ নিয়ে সংকট আরও বাড়লে একপর্যায়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধও হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ ধরনের পরিস্থিতিতেও তাৎক্ষিণক সংকট মোকাবিলায় পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী। তিনি বলেছেন, আকস্মিকভাবে গ্রিড বিপর্যয় ঘটলে কিংবা গ্রিড থেকে বড় কোনো সক্ষমতা আউট হয়ে গেলে তা মোকাবিলার জন্য মোটা দাগে দুটি বিষয় প্রস্তুতি ও পর্যবেক্ষণ থাকতে হয়। এর একটি হলো-যে সক্ষমতার সরবরাহ গ্রিডে কমছে, তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত রাখা। সে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান রাখা। দ্বিতীয়ত, পাওয়ার প্লান্ট নির্দিষ্ট একটি সময়ে রক্ষণাবেক্ষণে নিতে হয়। ফলে গ্রিড ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সবসময়ই হিসাবটাও রাখতে হয়। ফলে কোনো কারণে আমদানি বিদ্যুতের সরবরাহ কমে গেলে সেখানে সরবরাহ করতে হবে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালিয়ে।

বিপিডিবির এক কর্মকর্তা বলেছেন, দেশে জ্বালানি সংকট থাকায় আমদানি বিদ্যুতে নির্ভরতা বেড়েছে। কারণ সেই আমদানির পরিমাণটাও কম নয়। তবে কোনো কারণে সংকট তৈরি হলে জ্বালানি সংকটের যে চিত্র তার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা বা বিকল্প সরবরাহ সক্ষমতা এ মুহূর্তে তৈরি করা নেই। অন্যদিকে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় কলকারখানার উৎপাদনও চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় গ্যাস সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ার কারণে এ সমস্যা হচ্ছে। শুধু ব্যবসার ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য খাতেও গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে, বিশেষ করে সার ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে।

রূপসায় ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গ্যাসের জন্য চালু করা যাচ্ছে না। ব্যাপক লোডশেডিং থেকে মুক্তি পেতে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল) বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করে। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বেশি হারে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া শুরু হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০ পাস করা হয়, যা দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত। এ আইনের অধীন দরপত্র ছাড়াই নির্মাণ করা হয় একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রথমে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা যুক্ত হলেও পরে আওয়ামী লীগের নেতারা নিতে থাকেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ভারত থেকেও বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয়। গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা বেড়েছে পাঁচগুণের বেশি, উৎপাদন বেড়েছে ৩ দশমিক ৬ গুণ। আর কেন্দ্রভাড়া বেড়েছে ১৬ গুণ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মূলত বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে এভাবে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এ সময় দেখা গেছে, ৫ হাজার থেকে বেড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াট, যা চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ। যদিও অর্ধেকের মতো সক্ষমতা অলস পড়ে থাকে। পরিশোধ করতে হচ্ছে সক্ষমতার ভাড়া, যা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে পরিচিত।

বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন ক্ষমতা, খরচ কেন বাড়ল ইত্যাদি নিয়ে গত ২৫ আগস্ট বিদ্যুৎ বিভাগে একটি ব্যাখ্যা তুলে ধরেছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ খাতের দুজন ব্যবসায়ী বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকে। এটি হয়েছে মূলত জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায়। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয়ের ৬৫ শতাংশ হয় জ্বালানির দাম বাবদ। সেই জ্বালানির দাম বেড়েছে ১৬৩ শতাংশ। আমাদের দেশে যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আছে, সেগুলো চালু করলেও স্বয়ং সম্পূর্ণতা আসতে পারে। সেজন্য জা¦লানি আমদানি করে সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালালে বিদ্যুৎ স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসতে পারে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এটা নিয়ে ভাবতে হবে।