ঢাকা , মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নোয়াখালীতে ৪১৮৫ কোটি টাকার মতো লোকসান

নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিচ্ছে ক্ষতচিহ্ন। দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের সংকট ও সমস্যা। লোকসানে পড়ার আশঙ্কায় কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ ও গ্রামীণ সড়কসহ ব্রিজ-কালভার্ট। টিউবওয়েল বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। যার ফলে ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া। এ ছাড়া বন্যায় চর্মরোগসহ বাড়ছে পানিবাহিত নানা রোগ। বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী খালের মুখ বন্ধ থাকায় বেগমগঞ্জের পূর্বাঞ্চল ও সেনবাগ উপজেলার নিচু এলাকার কিছু অংশের মানুষ এখনও পানিবন্দি রয়েছে।

জেলা শহরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত পাড়া, শহরের বিভিন্ন অলি-গলিসহ নিচু এলাকার রাস্তাঘাট, সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদরাসার মাঠসহ অনেক জায়গায় এখনও পানি রয়েছে। জেলার সচেতন মহল বলছে, ভৌগোলিকভাবে নোয়াখালী অন্যান্য সমতল জেলা থেকে নিচু। প্রতি বছর বর্ষায় নোয়াখালীতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। কিন্তু এবার ভারী বৃষ্টি ও ভারতের ঢলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় নোয়াখালী জেলা শহরসহ জেলার আটটি উপজেলায় বন্যা দেখা দেয়। জেলা প্রশাসন সূত্র মতে, বন্যার কবলে পড়ায় নোয়াখালীতে বিভিন্ন খাত মিলে এ পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার ১৮৫ কোটি টাকার মতো লোকসান পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে বন্যার পানি পুরোপুরি সরে গেলে এ লোকসান আরও বাড়তে পারে। যা জেলার অর্থনীতিতে প্রভাব পড়তে পারে।

অন্যদিকে বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোতে পানি কমলেও দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় দুর্গম এলাকাগুলোর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না।

জেলায় বেড়েছে ডায়রিয়া ও সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা। নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ২০ শয্যার বিপরীতে ভর্তি রয়েছে প্রায় ৩৫০ জনের মতো ডায়রিয়া রোগী। এ পর্যন্ত এই হাসপাতালে ডায়রিয়ায় চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ২ হাজারের মতো রোগী। মারা গেছেন চারজন। এ ছাড়া সাপের কামড়ের চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ৩৫০ জন।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী কার্যালযের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজহারুল ইসলাম জানান, নোয়াখালীতে এ পর্যন্ত তিন হাজার কিলোমিটার রাস্তা নষ্ট হয়ে গেছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে প্রকৃত তথ্য জানা যাবে। তবে জেলার গ্রামীণ সড়ক খাতে বিশাল একটা ধাক্কা আসতে পারে।

সড়ক ও জনপদের নির্বাহী প্রকৌশলী সৌম্য তালুকদার জানান, বন্যায় নোয়াখালী জেলা সড়ক বিভাগের ১২৩ কিলোমিটার রাস্তা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। এ পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।

নোয়াখালী কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক ড. মীরা রানী দাস জানান, জেলাতে ৩৮ হাজার ৪৫৬ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৬৪৩ কোটি টাকার লোকাসান দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে রোপা আমন ২৫ হাজার ৬০১ হেক্টর, আমন বীজতলা ৪ হাজার ৫৩৬ হেক্টর, আউশ ৪ হাজার ৫২১ হেক্টর, শরৎকালীন সবজি ৩ হাজার ২১৬ হেক্টর, ফল বাগান ৪৩৭ হেক্টর, পানের বরজ ৫৭ হেক্টর, আখ ১৩ হেক্টর, আদা ২০ হেক্টর ও হলুদ ৫৫ হেক্টর ক্ষতি হয়েছে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসেন জানান, জেলায় ৮৫ হাজার ৩৭৯ মাছের ঘের, পুকুর ভেসে গেছে। মোট ৬ কোটি ১৬ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনেক শিক্ষিত যুবক-তরুণ, মধ্যবিত্ত পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের সূত্রে মতে, জেলাতে প্রায় ২ লাখের মতো পশু মারা গেছে। এর মধ্যে গরু-ছাগল, মুরগি-হাঁসসহ বিভিন্ন প্রাণী রয়েছে। জেলাতে প্রায় ১০৮টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নোয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে ঘুরে ৪টি ভ্রাম্যমাণ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ২০ লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। ৩ হাজার জেরিক্যান বিতরণ করে এবং ট্রাকে করে ২ হাজার লিটার পানির ট্যাঙ্ক দিয়ে পানি সরবরাহ করা হয়েছে।

জেলা রেড ক্রিসেন্ট সূত্রে জানা যায়, বিশুদ্ধ পানির সংকট কাটাতে তাদের পক্ষ থেকে দৈনিক ১ হাজার ৪০০ লিটার বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করার হচ্ছে। এ ছাড়া তাদের স্বেচ্ছাসেবীরা দিন-রাত বানভাসিদের বিভিন্ন সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, ভয়াবহ বন্যায় জেলাতে অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন খাত মিলে প্রায় ৪ হাজার ১৮৫ কোটি টাকার মতো। এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সহজেই সম্ভব হবে না। তবে আমরা পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরুর করে দিয়েছি। পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় অনেক দেশি-বিদেশি এনজিও, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করবে। সবার যৌথ প্রচেষ্টায় নোয়াখালী আবার ঘুরে দাঁড়াবে। বন্যা যেভাবে মোকাবিলা করেছি, আমরা সবাই মিলে আবার বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন সমস্যাও মোকাবিলা করব।

ট্যাগস
জনপ্রিয় সংবাদ

নোয়াখালীতে ৪১৮৫ কোটি টাকার মতো লোকসান

আপডেট সময় ০৫:১৩:২৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

নোয়াখালীতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিচ্ছে ক্ষতচিহ্ন। দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের সংকট ও সমস্যা। লোকসানে পড়ার আশঙ্কায় কৃষি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদ ও গ্রামীণ সড়কসহ ব্রিজ-কালভার্ট। টিউবওয়েল বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। যার ফলে ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া। এ ছাড়া বন্যায় চর্মরোগসহ বাড়ছে পানিবাহিত নানা রোগ। বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী খালের মুখ বন্ধ থাকায় বেগমগঞ্জের পূর্বাঞ্চল ও সেনবাগ উপজেলার নিচু এলাকার কিছু অংশের মানুষ এখনও পানিবন্দি রয়েছে।

জেলা শহরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত পাড়া, শহরের বিভিন্ন অলি-গলিসহ নিচু এলাকার রাস্তাঘাট, সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদরাসার মাঠসহ অনেক জায়গায় এখনও পানি রয়েছে। জেলার সচেতন মহল বলছে, ভৌগোলিকভাবে নোয়াখালী অন্যান্য সমতল জেলা থেকে নিচু। প্রতি বছর বর্ষায় নোয়াখালীতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। কিন্তু এবার ভারী বৃষ্টি ও ভারতের ঢলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় নোয়াখালী জেলা শহরসহ জেলার আটটি উপজেলায় বন্যা দেখা দেয়। জেলা প্রশাসন সূত্র মতে, বন্যার কবলে পড়ায় নোয়াখালীতে বিভিন্ন খাত মিলে এ পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজার ১৮৫ কোটি টাকার মতো লোকসান পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে বন্যার পানি পুরোপুরি সরে গেলে এ লোকসান আরও বাড়তে পারে। যা জেলার অর্থনীতিতে প্রভাব পড়তে পারে।

অন্যদিকে বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোতে পানি কমলেও দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় দুর্গম এলাকাগুলোর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না।

জেলায় বেড়েছে ডায়রিয়া ও সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা। নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ২০ শয্যার বিপরীতে ভর্তি রয়েছে প্রায় ৩৫০ জনের মতো ডায়রিয়া রোগী। এ পর্যন্ত এই হাসপাতালে ডায়রিয়ায় চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ২ হাজারের মতো রোগী। মারা গেছেন চারজন। এ ছাড়া সাপের কামড়ের চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ৩৫০ জন।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী কার্যালযের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজহারুল ইসলাম জানান, নোয়াখালীতে এ পর্যন্ত তিন হাজার কিলোমিটার রাস্তা নষ্ট হয়ে গেছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে প্রকৃত তথ্য জানা যাবে। তবে জেলার গ্রামীণ সড়ক খাতে বিশাল একটা ধাক্কা আসতে পারে।

সড়ক ও জনপদের নির্বাহী প্রকৌশলী সৌম্য তালুকদার জানান, বন্যায় নোয়াখালী জেলা সড়ক বিভাগের ১২৩ কিলোমিটার রাস্তা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। এ পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।

নোয়াখালী কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক ড. মীরা রানী দাস জানান, জেলাতে ৩৮ হাজার ৪৫৬ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৬৪৩ কোটি টাকার লোকাসান দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে রোপা আমন ২৫ হাজার ৬০১ হেক্টর, আমন বীজতলা ৪ হাজার ৫৩৬ হেক্টর, আউশ ৪ হাজার ৫২১ হেক্টর, শরৎকালীন সবজি ৩ হাজার ২১৬ হেক্টর, ফল বাগান ৪৩৭ হেক্টর, পানের বরজ ৫৭ হেক্টর, আখ ১৩ হেক্টর, আদা ২০ হেক্টর ও হলুদ ৫৫ হেক্টর ক্ষতি হয়েছে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসেন জানান, জেলায় ৮৫ হাজার ৩৭৯ মাছের ঘের, পুকুর ভেসে গেছে। মোট ৬ কোটি ১৬ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অনেক শিক্ষিত যুবক-তরুণ, মধ্যবিত্ত পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের সূত্রে মতে, জেলাতে প্রায় ২ লাখের মতো পশু মারা গেছে। এর মধ্যে গরু-ছাগল, মুরগি-হাঁসসহ বিভিন্ন প্রাণী রয়েছে। জেলাতে প্রায় ১০৮টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নোয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে ঘুরে ৪টি ভ্রাম্যমাণ ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ২০ লাখ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। ৩ হাজার জেরিক্যান বিতরণ করে এবং ট্রাকে করে ২ হাজার লিটার পানির ট্যাঙ্ক দিয়ে পানি সরবরাহ করা হয়েছে।

জেলা রেড ক্রিসেন্ট সূত্রে জানা যায়, বিশুদ্ধ পানির সংকট কাটাতে তাদের পক্ষ থেকে দৈনিক ১ হাজার ৪০০ লিটার বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করার হচ্ছে। এ ছাড়া তাদের স্বেচ্ছাসেবীরা দিন-রাত বানভাসিদের বিভিন্ন সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, ভয়াবহ বন্যায় জেলাতে অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন খাত মিলে প্রায় ৪ হাজার ১৮৫ কোটি টাকার মতো। এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সহজেই সম্ভব হবে না। তবে আমরা পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরুর করে দিয়েছি। পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় অনেক দেশি-বিদেশি এনজিও, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করবে। সবার যৌথ প্রচেষ্টায় নোয়াখালী আবার ঘুরে দাঁড়াবে। বন্যা যেভাবে মোকাবিলা করেছি, আমরা সবাই মিলে আবার বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন সমস্যাও মোকাবিলা করব।