ঢাকা , মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আজিমপুরে গুলিতে নিহত: শরীয়তপুরে তছনছ দুলালের সুখের সংসার

অভাবের সংসার কাটিয়ে সবেমাত্র সুখের মুখ দেখেছিলেন ব্যাংক কর্মচারী দুলাল মাহমুদ। ঘর করার জন্য গ্রামে কিনেছিলেন এক টুকরো জমিও। বাবা-মা, স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে পেতেছিলেন সুখের সংসার। তবে সেসব আজ শুধুই স্মৃতি। বুলেটের আঘাত কেড়ে নিয়েছে গোটা পরিবারের হাসি। এখন শুধু পরিবারে চলছে শোকের মাতম। ছেলে আর বাড়ি ফিরবে না, ডাকবে না মা বলে। এই কথা মনে করতেই ডুকরে কেঁদে উঠছেন মা জলেখা বিবি।

বিচার চান ছেলে হত্যার। জানা যায়, দুলাল মাহমুদের বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার চরখাগুটিয়া চৌকিদার কান্দি এলাকায়। সিদ্দিক খালাসি ও জলেখা বিবির সাত সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ। ছোটবেলা থেকেই দারুণ অর্থকষ্টে দিন কেটেছে তাদের। একদিকে বাবা কুষ্ঠরোগী, অন্যদিকে গরিব হওয়ায় ছোটবেলা থেকে কাজ শুরু করেন দুলাল। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে কখনো চালিয়েছেন ভ্যান, আবার কখনো কৃষি শ্রমিকের কাজ করেছেন।

২০০১ সালে পূর্ব নাওডোবা পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন দুলাল মাহমুদ। পরে ভাতের অভাবে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমান মুন্সীগঞ্জ জেলায়। সেখানে একটি বাড়িতে লজিং থেকে শেষ করেন উচ্চ মাধ্যমিক। এরপর ঢাকায় শুরু করেন চাকরির সন্ধান। ১৪ বছর আগে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকে চাকরি হয় তার। সুদিন ফিরে আসে। আট বছর আগে বিয়ে করেন। বর্তমানে তার সংসারে সাত বছরের আদিয়াত ও সাড়ে তিন বছরের আরিশা নামের দুই সন্তান রয়েছে।

দুলালের ছোট ভাই জসিম খালাসী প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বলেন, ১৮ জুলাই বিকাল থেকেই ঢাকার আজিমপুর এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল। এদিন অফিস শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন দুলাল মাহমুদ। বাসার সামনে গলির মাথায় আসতেই হঠাৎ একঝাঁক রাবার বুলেট এসে বিদ্ধ করে তার হাত আর পেটে। মুহূর্তেই সব শেষ। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন দুলাল। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান স্থানীয়রা। এর পরের দিন তার মৃত্যু হয়। পরে গ্রামের বাড়িতে তার লাশ দাফন করা হয়।

দুলাল মাহমুদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কেনা জমির পাশে তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। মা জলেখা বিবি তসবি জপে ছেলের জন্য দোয়া করছেন। ছেলের শোকে পাথর হয়ে বসে আছেন বাবা সিদ্দিক খালাসি।

জলেখা বিবি বলেন, ‘ছোটবেলা থিকা পোলারে দুইডা টাকা দিতে পারি নাই। নিজে বদলা (কৃষিশ্রম) দিয়া, মানুষের দোকানে কাম কইরা পড়ালেহা করছে। এহন সে চাকরি পাইছে। কিন্তু আমার নির্দোষ পোলাডারে মাইরা ফেলল। আমার বুক খালি কইরা, আমার নাতি-নাতকুর দুইডারে এতিম বানাইয়া দিল। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’

দুলালের ছোট ভাই জসিম খালাসি বলেন, ‘তিনিই আমাগো দেইখা রাখতেন। আজ তিনি আর নাই। আমাদের একটাই দাবি, ভাইয়ের পরিবারটির পাশে যেন সরকার দাঁড়ায়।’

পূর্ব নাওডোবা পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ইদ্রিস আলী বলেন, আমরা ওকে (দুলাল) কখনো দেখিনি রাজনীতি করতে বা কারও সঙ্গে উচ্চবাচ্য করতে। আমরা চাই সরকার পরিবারটির পাশে দাঁড়াক।’

ট্যাগস
জনপ্রিয় সংবাদ

আজিমপুরে গুলিতে নিহত: শরীয়তপুরে তছনছ দুলালের সুখের সংসার

আপডেট সময় ০৪:৫৯:০৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০২৪

অভাবের সংসার কাটিয়ে সবেমাত্র সুখের মুখ দেখেছিলেন ব্যাংক কর্মচারী দুলাল মাহমুদ। ঘর করার জন্য গ্রামে কিনেছিলেন এক টুকরো জমিও। বাবা-মা, স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে পেতেছিলেন সুখের সংসার। তবে সেসব আজ শুধুই স্মৃতি। বুলেটের আঘাত কেড়ে নিয়েছে গোটা পরিবারের হাসি। এখন শুধু পরিবারে চলছে শোকের মাতম। ছেলে আর বাড়ি ফিরবে না, ডাকবে না মা বলে। এই কথা মনে করতেই ডুকরে কেঁদে উঠছেন মা জলেখা বিবি।

বিচার চান ছেলে হত্যার। জানা যায়, দুলাল মাহমুদের বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার চরখাগুটিয়া চৌকিদার কান্দি এলাকায়। সিদ্দিক খালাসি ও জলেখা বিবির সাত সন্তানের মধ্যে তিনি চতুর্থ। ছোটবেলা থেকেই দারুণ অর্থকষ্টে দিন কেটেছে তাদের। একদিকে বাবা কুষ্ঠরোগী, অন্যদিকে গরিব হওয়ায় ছোটবেলা থেকে কাজ শুরু করেন দুলাল। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে কখনো চালিয়েছেন ভ্যান, আবার কখনো কৃষি শ্রমিকের কাজ করেছেন।

২০০১ সালে পূর্ব নাওডোবা পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন দুলাল মাহমুদ। পরে ভাতের অভাবে গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমান মুন্সীগঞ্জ জেলায়। সেখানে একটি বাড়িতে লজিং থেকে শেষ করেন উচ্চ মাধ্যমিক। এরপর ঢাকায় শুরু করেন চাকরির সন্ধান। ১৪ বছর আগে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকে চাকরি হয় তার। সুদিন ফিরে আসে। আট বছর আগে বিয়ে করেন। বর্তমানে তার সংসারে সাত বছরের আদিয়াত ও সাড়ে তিন বছরের আরিশা নামের দুই সন্তান রয়েছে।

দুলালের ছোট ভাই জসিম খালাসী প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বলেন, ১৮ জুলাই বিকাল থেকেই ঢাকার আজিমপুর এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল। এদিন অফিস শেষ করে বাসায় ফিরছিলেন দুলাল মাহমুদ। বাসার সামনে গলির মাথায় আসতেই হঠাৎ একঝাঁক রাবার বুলেট এসে বিদ্ধ করে তার হাত আর পেটে। মুহূর্তেই সব শেষ। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন দুলাল। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান স্থানীয়রা। এর পরের দিন তার মৃত্যু হয়। পরে গ্রামের বাড়িতে তার লাশ দাফন করা হয়।

দুলাল মাহমুদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কেনা জমির পাশে তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। মা জলেখা বিবি তসবি জপে ছেলের জন্য দোয়া করছেন। ছেলের শোকে পাথর হয়ে বসে আছেন বাবা সিদ্দিক খালাসি।

জলেখা বিবি বলেন, ‘ছোটবেলা থিকা পোলারে দুইডা টাকা দিতে পারি নাই। নিজে বদলা (কৃষিশ্রম) দিয়া, মানুষের দোকানে কাম কইরা পড়ালেহা করছে। এহন সে চাকরি পাইছে। কিন্তু আমার নির্দোষ পোলাডারে মাইরা ফেলল। আমার বুক খালি কইরা, আমার নাতি-নাতকুর দুইডারে এতিম বানাইয়া দিল। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।’

দুলালের ছোট ভাই জসিম খালাসি বলেন, ‘তিনিই আমাগো দেইখা রাখতেন। আজ তিনি আর নাই। আমাদের একটাই দাবি, ভাইয়ের পরিবারটির পাশে যেন সরকার দাঁড়ায়।’

পূর্ব নাওডোবা পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ইদ্রিস আলী বলেন, আমরা ওকে (দুলাল) কখনো দেখিনি রাজনীতি করতে বা কারও সঙ্গে উচ্চবাচ্য করতে। আমরা চাই সরকার পরিবারটির পাশে দাঁড়াক।’