কী খাবে দেশের মানুষ। একটার পর একটা পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েই চলেছে। পণ্যমূল্য বাড়তে বাড়তে এখন সাধারণ মানুষের সহ্যসীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনকার তিন বেলার আহার জোটাতে অতি জরুরি দরকারি পণ্য যেমন-চাল, আলু, পেঁয়াজ, ডিম, সবজির মতো পণ্যগুলোর দাম বাড়ছে সবচেয়ে বেশি। দুয়েকটির কারণে এসব পণ্যের দাম যেটুকু বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি বাড়ছে এসব পণ্যের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে। এবার বাজারে তৈরি হয়েছে সয়াবিন তেল সিন্ডিকেট।
তাদের ইচ্ছে জেগেছে নতুন করে ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানো, তাই মিল মালিক ও আমদানিকারকরা মিলেমিশে বাজারে ইচ্ছেকৃতভাবে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে গত দুই সপ্তাহ ধরে বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যেই খোলা সয়াবিন তেলে কেজিতে ১২-১৫ টাকা দাম বাড়ানো হয়েছে, আর সরকারের অনুমতি মেলার আগেই লিটারে ১২ টাকা দাম বাড়িয়ে নতুন মূল্যের সয়াবিন তেলের বোতল প্রস্তুত শুরু করেছে মিল মালিকরা।
যদিও প্রায় এক মাস আগে মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনে জমা দিয়েছিল ভোজ্য তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে-এখন ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। তাই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হলেও মিল মালিকরা আপাতত দাম বাড়াতে পারছেন না ভোজ্য তেলের। তবে তার বদলে সরকারের কাছ থেকে শুল্ক কমানোর সুবিধা ঠিকই নিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ট্যারিফ কমিশনে ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীরা এ দফায় বোতলজাত সয়াবিনে লিটারে ১২ টাকা, খোলা সয়াবিনে কেজিতে ১০ টাকা এবং পাম অয়েলে লিটারে ১৩ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আর এই প্রস্তাব জমা দেওয়ার পরপরই বাজারেও তেলের সরবরাহ কমানো হয় কৃত্রিম সংকট তৈরিতে। তার অংশ হিসেবে গত দুই সপ্তাহ ধরে বাজারে বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহ প্রায় অর্ধেক কমিয়ে আনা হয়।
রাজধানীর কল্যাণপুর নতুন বাজারের মুদি দোকানদার সিরাজুল ইসলাম সময়ের আলোকে জানান, তার দোকানে এখন কোনো কোম্পানির বোতলজাত সয়াবিন তেল নেই। কারণ দাম বাড়ানো হবে বলে দুই সপ্তাহ ধরে কোম্পানিগুলো তেল দিচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘আমার আগের কেনা তেল ছিল কিছু, সেগুলো দিয়েই কয়েক দিন দোকান চালিয়েছি। নতুন করে অর্ডার দিলেও কোম্পানি থেকে তেল দেওয়া হচ্ছে না। এতে আমরা চরম বিপাকে পড়েছি। প্রতিবারই কোম্পানিগুলো যখন দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়-ঠিক তার আগ দিয়ে সরবরাহ কমিয়ে দেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমরা ক্রেতাকে সয়াবিন তেল দিতে পারছি না।’
এদিকে দাম বাড়ানোর পক্ষে ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে যুক্তি দেখানো হচ্ছে-বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলের। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার চৌধুরী বলেন, গত এপ্রিলে যখন সবশেষ সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল তখন বিশ্ববাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম ছিল ৮৭৩ ডলার, এখন সেটি বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ২ ডলার। আর সে সময় প্রতি টন পাম অয়েলের দাম ছিল ৯১০ ডলার, এখন সেটি বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ২৫ ডলার। তাই স্বাভাবিকভাবেই দাম বাড়ানো প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
দাম না বাড়িয়ে শুল্ক অব্যাহতির প্রস্তাব : ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে চাইলেও সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। এর বিপরীতে ভোজ্য তেল আমদানিতে আমদানি পর্যায়ে বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ অব্যাহতির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি উৎপাদক ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে আরোপিত সমুদয় মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) অব্যাহতির প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে এ প্রস্তাব করা হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
সবশেষ গত ১৮ এপ্রিল সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলের মূল্য সমন্বয় করা হয়। এরপর গত কয়েক মাসে বিশ্ববাজারে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলের দাম। এর মধ্যে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের মূল্য বেড়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এ ছাড়া আরবিডি পাম অয়েলের মূল্য ১৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেড়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য বৃদ্ধি না করে আমদানি পর্যায়ে বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং স্থানীয় উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ ধরনের শুল্ক অব্যাহতির ফলে ভোজ্য তেলের মূল্য বৃদ্ধি না করে বিদ্যমান মূল্য বহাল থাকবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। এর আগে তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে মূল্য সমন্বয়ের আবেদন করেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) এ বিষয়ে প্রস্তাব বা সুপারিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে এনবিআর।
বৈঠকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাং সেলিম উদ্দিন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মইনুল খানসহ ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সব জায়গাতেই এখনও আগের সরকারের লোক থাকায় ভাঙা যাচ্ছে না সিন্ডিকেট।
এদিকে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি এসএম নাজের হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, ‘রোগ তো একটাই-ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায়। তারা বারবার পার পেয়ে যাওয়ায় কোনো কিছুই তোয়াক্কা করছে না। এ ছাড়া আমলাদেরও এখানে ইন্টারেস্ট রয়েছে। ব্যবসায়ীরা আমলাদের মাসোহারা দিয়ে কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে। ট্যারিফ কমিশন দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার কথা। শাস্তি যদি নিশ্চিত করা না যায় তা হলে কিছুই হবে না। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাজার কারসাজি যারা করছে তাদের বিশেষ আইনে বিচার করা হবে। তবে এটি বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। কাজ করে দেখাতে হবে। আসলে আগের সরকারের মতো শুধু কথা হচ্ছে-কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কারণ সেটআপ তো আগের লোকেরাই। এরাই তো আগে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারে সহযোগিতা করেছে-তাদের মাধ্যমেই পাচার হয়েছে টাকা। তারাই এখনও বহাল তবিয়তে আছে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ভাঙার পাশাপাশি আমলা সিন্ডিকেটও না ভাঙা পর্যন্ত বাজারে স্বস্তি আসবে না।