ঢাকা , রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দেশে ফিরতে পারেননি অধিকাংশ স্বৈরশাসক

গত কয়েক দশকে গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন অনেক স্বৈরশাসক। কিন্তু দেশত্যাগ করে পালানোর পর দেশে ফিরতে পারেননি তাদের অনেকেই। আর যে কয়জন দেশে ফিরতে পেরেছেন, তাদের বেশিরভাগই রাজনীতিতে নিজেকে আর পুনর্বাসন করতে পারেননি।

বলিভিয়ার ইভো মোরালেস দেশটির প্রথম ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সে জায়গা থেকে শুরুতে জননন্দিতও হয়েছিলেন। তার কিছু সংস্কার বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল। কিন্তু যেনতেন উপায়ে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রয়াস তাকে একপর্যায়ে জনগণের সামনে উপস্থাপন করে স্বৈরশাসক হিসেবে। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পর ২০১৯ সালে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে বিক্ষোভ শুরু হয়। গণরোষের মুখে পদত্যাগ করে মেক্সিকো পালিয়ে যান তিনি। পরে দেশে ফিরলেও রাজনীতিতে আর সুবিধা করে উঠতে পারেননি তিনি।

স্বদেশে ফিরতে পারলেও জীবনের বাকি সময় কারাগারেই পার করতে হয়েছে চিলির স্বৈরশাসক অগাস্তো পিনোশেকে। ক্ষমতা হারানোর পর লন্ডনে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৯৮ সালের ১০ অক্টোবর স্প্যানিশ একটি আদালতের পরোয়ানার ভিত্তিতে লন্ডন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। আইনি লড়াই চালিয়ে গেলেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। তাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠায় ব্রিটিশ সরকার। দেশে ফেরার পর তার বিরুদ্ধে হত্যা, গুম, নির্যাতনের সুনির্দিষ্ট ঘটনায় দায়ের করা হয় মামলা। সেই মামলার দায় নিয়েই ৯১ বছর বয়সে পিনোশে যখন মারা যান তখনো তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ৩০০ ফৌজদারি অপরাধের মামলা চলছিল।

শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে পড়ার কিছুদিনের মধ্যেই জনরোষের মুখে পড়ে রাজাপাকসে পরিবার। মে মাসে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে সেনাবাহিনীর কাছে আশ্রয় নেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। জুলাইয়ে গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশত্যাগ করে প্রথমে মালদ্বীপে, পরে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান। তার আনুষ্ঠানিক পদত্যাগের ঘোষণা দেন শ্রীলঙ্কার সংসদ স্পিকার। এর প্রায় দেড় মাস পর ‘বিশেষ নিরাপত্তা’ নিয়ে তিনি ফেরত আসেন নিজ দেশে। যদিও এখনও রাজনীতিতে ফিরতে পারেননি গোতাবায়া রাজাপাকসে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা অপরাধেরও অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে।

তিউনিশিয়ার স্বৈরশাসক জাইন এল-আবিদিন বেন আলির বিরুদ্ধে ২০১১ সালে ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়, যা জেসমিন বিপ্লব নামে পরিচিত। এটি একসময় জন্ম দেয় আরব বসন্তের। সে বিপ্লবের একপর্যায়ে বেন আলির ২৩ বছরের মসনদ হাতছাড়া হয়। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে সপরিবারে সৌদি আরবে পালিয়ে যান বেন আলি। এরপর আর দেশে ফিরতে পারেননি তিনি। সৌদি আরবে নির্বাসিত জীবনযাপন করেন। ৮৩ বছর বয়সে সেখানেই মৃত্যু হয় তার।

২০১৪ সালে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করেন আশরাফ গানি। তবে ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মার্কিন সৈন্যদের শেষ দলটি আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এর সঙ্গে সঙ্গেই একের পর এক শহর দখলের অভিযান শুরু করে দেয় তালেবানরা। এরই ধারাবাহিকতায় কাবুলেও অভিযান চালায়। তালেবানদের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছাকাছি চলে আসার খবর পেয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয় আশরাফ গানিকে।

কিন্তু দেশ পালানো শাসকদের মধ্যে তার অবস্থাটি ছিল ভিন্ন। তিনি খালি হাতে দেশত্যাগ করেননি। বরং চারটি গাড়ি ও হেলিকপ্টারে ভরে নগদ অর্থ নিয়ে ওমান হয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পালিয়ে যান। ২০২১ সাল থেকে সেখানেই মানবিক আশ্রয়ে আছেন এ নেতা। নিজ দেশ ও রাজনীতি কোনোটিতেই ফেরা হয়নি আফগান এ নেতার।

লিবিয়ার ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী নেতা, যিনি বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন, তার ছেলে সাইফ আল-ইসলাম গাদ্দাফি লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেবেন। যদিও লিবিয়ায় ২০২৪ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেটি নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। নির্বাচন যখনই অনুষ্ঠিত হোক না কেন, ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচার ময়াম্মার গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল ইসলাম গাদ্দাফি রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার বিচার চলছে। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে আরব বিশ্বে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল তার ফলে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন মিসরের হুসনি মুবারক, যিনি ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। হুসনি মুবারকের ছেলে গামাল মুবারকের পক্ষে অনলাইন প্রচারণা শুরু করেন অনেক মিসরীয়। এসব প্রচারণার মাধ্যমে তারা মিসরের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গামাল মুবারককে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান বলে জানান। অনেকে মিসরীয় তাদের ফেসবুক এবং টুইটারে লেখেন, মিসরের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকট কাটানোর জন্য গামাল মুবারক একমাত্র সমাধান। কিন্তু গামাল মুবারক শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি।

১৯৯৮ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো। তার ক্ষমতাচ্যুতির পরে দেশটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে পড়ে। সুহার্তো ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার ১৬ বছর পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনে তার মেয়ে সিতি হেদাইতি সুহার্তো, যিনি তিতেক সুহার্তো হিসেবে পরিচিত, নির্বাচনে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা করেছেন। ২০১৬ সালে সুহার্তোর ছেলে টমি সুহার্তো একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এই দলে সুহার্তোর মেয়ে থাকলেও পরবর্তীতে তিনি সেটি ত্যাগ করে গেরিন্দ্র পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। এই পার্টির নেতা হচ্ছেন তার সাবেক স্বামী। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে সুহার্তোর মেয়েকে দলটির উপদেষ্টা বানানো হয়েছিল। সে নির্বাচনে তার স্বামী প্রাবোউ সুবিনাতো জয়লাভ করেন।

ফিলিপিন্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফার্ডিন্যান্ড ই মার্কোস ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমানে করে গুয়াম দ্বীপে আশ্রয় নেন। মার্কোস ২১ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। স্বৈরাচার মার্কোস ক্ষমতাচ্যুত ও পালিয়ে যাওয়ার ৩৬ বছর পরে ২০২২ সালে তার ছেলে ফার্ডিন্যান্ড মার্কোস জুনিয়র ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের রাজনৈতিক জীবন বেশ উত্থান-পতনের ভেতরে দিয়ে যাচ্ছে। শরিফ তিনবার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন এবং বারবারই ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। কারগিল যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ১৯৯৯ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন নওয়াজ শরিফ। এরপর সেনাপ্রধান তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এরপর তাকে বিচারের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
কিন্তু তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং সৌদি বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজের মধ্যস্থতায় নওয়াজ শরিফ ছাড়া পেয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে সৌদি আরব চলে যান ২০০২ সালে। ২০০৭ সালেও তিনি ফিরে এসেছিলেন, যখন তিনি ও তার প্রতিপক্ষ বেনজীর ভুট্টো সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে আসেন। এরপর ২০২৪ সালের নির্বাচনে নওয়াজ শরীফের দল ৭৫ আসনে জয়লাভ করে। পরে রাজনৈতিক শরিকদের নিয়ে সরকার গঠন করা হলে তার ভাই শাহবাজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হন।

গণঅভ্যুত্থানে দেশত্যাগকারীদের তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছাড়েন তিনি। গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশ ছাড়ার আগে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা। বর্তমানে ভারতে নিরাপদ আশ্রয়ে আছেন তিনি। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় তার মা আর রাজনীতি করবেন না বলে ঘোষণা দেন।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগকারীদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। বিদ্রোহী যোদ্ধাদের রাজধানী দামেস্ক দখলের মুখে রোববার সকালে ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে দেশ ছাড়েন তিনি। বাশার আল-আসাদ টানা ২৪ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এর আগে তার বাবা হাফিজ আল-আসাদ টানা ২৯ বছর সিরিয়া শাসন করেন। বাশার আল-আসাদের পালানোর মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় ৫৩ বছরের আল-আসাদ পরিবারের শাসনের অবসান হলো।

আপলোডকারীর তথ্য

Rudra Kantho24

জনপ্রিয় সংবাদ

দেশে ফিরতে পারেননি অধিকাংশ স্বৈরশাসক

আপডেট সময় ১০:১৯:০৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৪

গত কয়েক দশকে গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন অনেক স্বৈরশাসক। কিন্তু দেশত্যাগ করে পালানোর পর দেশে ফিরতে পারেননি তাদের অনেকেই। আর যে কয়জন দেশে ফিরতে পেরেছেন, তাদের বেশিরভাগই রাজনীতিতে নিজেকে আর পুনর্বাসন করতে পারেননি।

বলিভিয়ার ইভো মোরালেস দেশটির প্রথম ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সে জায়গা থেকে শুরুতে জননন্দিতও হয়েছিলেন। তার কিছু সংস্কার বেশ জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল। কিন্তু যেনতেন উপায়ে ক্ষমতা ধরে রাখার প্রয়াস তাকে একপর্যায়ে জনগণের সামনে উপস্থাপন করে স্বৈরশাসক হিসেবে। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পর ২০১৯ সালে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে বিক্ষোভ শুরু হয়। গণরোষের মুখে পদত্যাগ করে মেক্সিকো পালিয়ে যান তিনি। পরে দেশে ফিরলেও রাজনীতিতে আর সুবিধা করে উঠতে পারেননি তিনি।

স্বদেশে ফিরতে পারলেও জীবনের বাকি সময় কারাগারেই পার করতে হয়েছে চিলির স্বৈরশাসক অগাস্তো পিনোশেকে। ক্ষমতা হারানোর পর লন্ডনে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৯৮ সালের ১০ অক্টোবর স্প্যানিশ একটি আদালতের পরোয়ানার ভিত্তিতে লন্ডন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। আইনি লড়াই চালিয়ে গেলেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। তাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠায় ব্রিটিশ সরকার। দেশে ফেরার পর তার বিরুদ্ধে হত্যা, গুম, নির্যাতনের সুনির্দিষ্ট ঘটনায় দায়ের করা হয় মামলা। সেই মামলার দায় নিয়েই ৯১ বছর বয়সে পিনোশে যখন মারা যান তখনো তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ৩০০ ফৌজদারি অপরাধের মামলা চলছিল।

শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে পড়ার কিছুদিনের মধ্যেই জনরোষের মুখে পড়ে রাজাপাকসে পরিবার। মে মাসে ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে সেনাবাহিনীর কাছে আশ্রয় নেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। জুলাইয়ে গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশত্যাগ করে প্রথমে মালদ্বীপে, পরে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান। তার আনুষ্ঠানিক পদত্যাগের ঘোষণা দেন শ্রীলঙ্কার সংসদ স্পিকার। এর প্রায় দেড় মাস পর ‘বিশেষ নিরাপত্তা’ নিয়ে তিনি ফেরত আসেন নিজ দেশে। যদিও এখনও রাজনীতিতে ফিরতে পারেননি গোতাবায়া রাজাপাকসে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা অপরাধেরও অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে।

তিউনিশিয়ার স্বৈরশাসক জাইন এল-আবিদিন বেন আলির বিরুদ্ধে ২০১১ সালে ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়, যা জেসমিন বিপ্লব নামে পরিচিত। এটি একসময় জন্ম দেয় আরব বসন্তের। সে বিপ্লবের একপর্যায়ে বেন আলির ২৩ বছরের মসনদ হাতছাড়া হয়। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে সপরিবারে সৌদি আরবে পালিয়ে যান বেন আলি। এরপর আর দেশে ফিরতে পারেননি তিনি। সৌদি আরবে নির্বাসিত জীবনযাপন করেন। ৮৩ বছর বয়সে সেখানেই মৃত্যু হয় তার।

২০১৪ সালে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করেন আশরাফ গানি। তবে ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মার্কিন সৈন্যদের শেষ দলটি আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এর সঙ্গে সঙ্গেই একের পর এক শহর দখলের অভিযান শুরু করে দেয় তালেবানরা। এরই ধারাবাহিকতায় কাবুলেও অভিযান চালায়। তালেবানদের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছাকাছি চলে আসার খবর পেয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয় আশরাফ গানিকে।

কিন্তু দেশ পালানো শাসকদের মধ্যে তার অবস্থাটি ছিল ভিন্ন। তিনি খালি হাতে দেশত্যাগ করেননি। বরং চারটি গাড়ি ও হেলিকপ্টারে ভরে নগদ অর্থ নিয়ে ওমান হয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পালিয়ে যান। ২০২১ সাল থেকে সেখানেই মানবিক আশ্রয়ে আছেন এ নেতা। নিজ দেশ ও রাজনীতি কোনোটিতেই ফেরা হয়নি আফগান এ নেতার।

লিবিয়ার ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী নেতা, যিনি বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন, তার ছেলে সাইফ আল-ইসলাম গাদ্দাফি লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেবেন। যদিও লিবিয়ায় ২০২৪ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেটি নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। নির্বাচন যখনই অনুষ্ঠিত হোক না কেন, ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচার ময়াম্মার গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল ইসলাম গাদ্দাফি রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার বিচার চলছে। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে আরব বিশ্বে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল তার ফলে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন মিসরের হুসনি মুবারক, যিনি ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। হুসনি মুবারকের ছেলে গামাল মুবারকের পক্ষে অনলাইন প্রচারণা শুরু করেন অনেক মিসরীয়। এসব প্রচারণার মাধ্যমে তারা মিসরের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গামাল মুবারককে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান বলে জানান। অনেকে মিসরীয় তাদের ফেসবুক এবং টুইটারে লেখেন, মিসরের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকট কাটানোর জন্য গামাল মুবারক একমাত্র সমাধান। কিন্তু গামাল মুবারক শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি।

১৯৯৮ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো। তার ক্ষমতাচ্যুতির পরে দেশটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে পড়ে। সুহার্তো ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার ১৬ বছর পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনে তার মেয়ে সিতি হেদাইতি সুহার্তো, যিনি তিতেক সুহার্তো হিসেবে পরিচিত, নির্বাচনে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা করেছেন। ২০১৬ সালে সুহার্তোর ছেলে টমি সুহার্তো একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এই দলে সুহার্তোর মেয়ে থাকলেও পরবর্তীতে তিনি সেটি ত্যাগ করে গেরিন্দ্র পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। এই পার্টির নেতা হচ্ছেন তার সাবেক স্বামী। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে সুহার্তোর মেয়েকে দলটির উপদেষ্টা বানানো হয়েছিল। সে নির্বাচনে তার স্বামী প্রাবোউ সুবিনাতো জয়লাভ করেন।

ফিলিপিন্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফার্ডিন্যান্ড ই মার্কোস ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমানে করে গুয়াম দ্বীপে আশ্রয় নেন। মার্কোস ২১ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। স্বৈরাচার মার্কোস ক্ষমতাচ্যুত ও পালিয়ে যাওয়ার ৩৬ বছর পরে ২০২২ সালে তার ছেলে ফার্ডিন্যান্ড মার্কোস জুনিয়র ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের রাজনৈতিক জীবন বেশ উত্থান-পতনের ভেতরে দিয়ে যাচ্ছে। শরিফ তিনবার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন এবং বারবারই ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। কারগিল যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ১৯৯৯ সালে তৎকালীন সেনাপ্রধানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন নওয়াজ শরিফ। এরপর সেনাপ্রধান তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এরপর তাকে বিচারের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
কিন্তু তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং সৌদি বাদশাহ ফাহাদ বিন আবদুল আজিজের মধ্যস্থতায় নওয়াজ শরিফ ছাড়া পেয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে সৌদি আরব চলে যান ২০০২ সালে। ২০০৭ সালেও তিনি ফিরে এসেছিলেন, যখন তিনি ও তার প্রতিপক্ষ বেনজীর ভুট্টো সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে আসেন। এরপর ২০২৪ সালের নির্বাচনে নওয়াজ শরীফের দল ৭৫ আসনে জয়লাভ করে। পরে রাজনৈতিক শরিকদের নিয়ে সরকার গঠন করা হলে তার ভাই শাহবাজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী হন।

গণঅভ্যুত্থানে দেশত্যাগকারীদের তালিকায় রয়েছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছাড়েন তিনি। গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশ ছাড়ার আগে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন শেখ হাসিনা। বর্তমানে ভারতে নিরাপদ আশ্রয়ে আছেন তিনি। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় তার মা আর রাজনীতি করবেন না বলে ঘোষণা দেন।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগকারীদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। বিদ্রোহী যোদ্ধাদের রাজধানী দামেস্ক দখলের মুখে রোববার সকালে ব্যক্তিগত উড়োজাহাজে দেশ ছাড়েন তিনি। বাশার আল-আসাদ টানা ২৪ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এর আগে তার বাবা হাফিজ আল-আসাদ টানা ২৯ বছর সিরিয়া শাসন করেন। বাশার আল-আসাদের পালানোর মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় ৫৩ বছরের আল-আসাদ পরিবারের শাসনের অবসান হলো।