ঢাকা , বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo পলাতক ফ্যাসিস্ট হাসিনার মৃত্যুদণ্ড Logo ‘আপনাদের ওপর আল্লাহর গজব পড়বে’ সত্য হলো খালেদা জিয়ার সেই কান্নাজড়িত বক্তব্য Logo বিএনপির কঠিন সময়ে আমি নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম তাই দল আমাকে মূল্যায়ন করেছে বললেন আজহারুল ইসলাম মান্নান Logo গোদনাইল মেঘনা পেট্রোলিয়াম ডিপো এখন ডি এস মাহবুব এর দখলে Logo মহানগর বিএনপির উদ্যোগ আওয়ামী লীগের শাটডাউনের প্রতিবাদে সভা ও র‍্যালি অনুষ্ঠিত Logo সতর্ক অবস্থানে পুলিশ, জেলাজুড়ে টহল কার্যক্রম জোরদার Logo সিদ্ধিরগঞ্জে গাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ২ মামলা, আসামি ৪০ Logo র‌্যাবের অভিযান টের পেয়ে সন্ত্রাসীর গুলিতে নারী গুলিবিদ্ধ Logo না’গঞ্জের সর্বশ্রেনীর মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত বিদায়ী জেলা প্রশাসক মানবিক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা Logo সেনেগালকে হারিয়ে ব্রাজিলের উল্লাস

পলাতক ফ্যাসিস্ট হাসিনার মৃত্যুদণ্ড

অবিশ্বাস্য এক ঘটনা ঘটল বাংলাদেশে। টানা সাড়ে ১৫ বছরের অপশাসনে শেখ হাসিনার কখনো মনে হয়নি, জীবনে তাকে এমন এক পরিণতি বরণ করতে হবে। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে সেই ঘটনাই ঘটেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে ভারতে পলাতক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। একই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আরেক আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) রাজসাক্ষী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দেওয়া হয়েছে ৫ বছরের লঘুদণ্ড। রায়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি যারা ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের কনসিডারেবল অ্যামাউন্ট (উল্লেখযোগ্য পরিমাণ) আন্দোলনকারীদের ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া আহত আন্দোলনকারীদের আঘাতের মাত্রা ও ক্ষতি বিবেচনায় পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে রায়ে।

সোমবার দুপুরে জনাকীর্ণ আদালতে বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সোমবার এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণা উপলক্ষ্যে জুলাই শহীদপরিবারের সদস্য এবং আহতদের বেশ কয়েকজন ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। রায়ে শেখ হাসিনার ফাঁসির আদেশ শুনে আলহামদুলিল্লাহ বলে সন্তোষ প্রকাশ করেন তারা। শহীদ আনাসের মা সন্তানের স্মৃতি মনে করে কেঁদে ফেলেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, এটি যুগান্তকারী রায়। ভারত থেকে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন জুলাই যোদ্ধাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। তারা চৌধুরী মামুনের সাজা কম হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক থাকায় রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিলের সুযোগ পাচ্ছেন না। আপিল করতে হলে তাদের ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করতে হবে। শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবীও বলেছেন, আইনে না থাকায় তার আসামির আপিলের সুযোগ নেই।

জুলাই আন্দোলনে ১৪০০ ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে করা কোনো মামলায় এটিই প্রথম রায়। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

জনগণকে জিম্মি করে স্বৈরাচারী কায়দায় সাড়ে ১৫ বছর দেশে শাসনের নামে পরিবারতন্ত্র কায়েক করেছিলেন শেখ হাসিনা। তার আশপাশে গড়ে তোলেন চাটুকার বাহিনী। তাদের সবার স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন জনগণের প্রতিপক্ষ। কিন্তু তার গুম-খুন বাহিনীর ভয়ে কেউ তার অপশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে পরত না। ২০২৪ সালের আমি আর ডামি নির্বচনের মধ্য দিয়ে একদলীয় শাসনের চূড়ান্ত নীলনকশা নতুন প্রজন্ম ও ছাত্রছাত্রীরা বুঝতে পেরে তারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোটা সংস্কার আন্দোলন ইস্যুতে মাঠে নামে। শেষ পর্যন্ত টানা ৩৬ দিনের আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তিনি কোনো মতে ভারতে পালিয়ে গিয়ে নিজের জীবন রক্ষা করেন। তার সঙ্গে ছোট বোন শেখ রেহানাও পালিয়ে যান। শেখ হাসিনা ভারতে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন বলে রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ করে আসছে। তার বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যার রায় যত এগিয়ে আসছিল, তিনি ততই বেপরোয়া আচরণ শুরু করেন। তার নির্দেশে দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত দলটির কিছু দুষ্কৃতকারী কর্মী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর অবস্থানে থাকায় তারা সুবিধা করতে পারেনি। এমন বাস্তবতায় সোমবার দেওয়া হলো ঐতিহাসিক সেই রায়। যার জন্য দেশবাসী ৫ আগস্টের পর থেকে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় ছিলেন।

শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রথম সাবেক সরকারপ্রধান, যার মাথার ওপর এখন ঝুলছে মৃত্যুদণ্ডের রায়। এর আগে আর কোনো সরকারপ্রধানকে এভাবে গণহত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ডের মুখে পড়তে হয়নি কোনো আদালত থেকেই। এবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকেই শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ সাজার রায় এলো, যে আদালত তার সরকার গঠন করেছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে ভিন্নমতের রাজনীতির মুখ বন্ধ করার জন্য।

সোমবার বেলা সাড়ে ১২টায় জনাকীর্ণ আদালতে রায় পড়া শুরু হয়। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেনসহ আইনজীবী, শহীদপরিবারের সদস্য, আহত ও পঙ্গু জুলাই যোদ্ধা এবং বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকর্মী উপস্থিত ছিলেন। দণ্ড ঘোষণার মধ্য দিয়ে বেলা ২টা ৫৪ মিনিটে ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায় পড়া শেষ হয়। রায়ের কার্যক্রম বিটিভির মাধ্যমে সরাসরি সব টিভি চ্যানেল প্রচার করে।

ঘোষিত এ রায়ে মোট ছয়টি অংশ ছিল। ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় সদস্য বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী এবং প্রথম সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ রায়ের দুটি অংশ পড়ে শোনান। সবশেষে আসামিদের সাজার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার। বিচারক শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করতেই এজলাসে উপস্থিত অনেকেই হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান তখন ডায়াসে যান এবং সবাইকে ট্রাইব্যুনালের সুষ্ঠু পরিবেশ বজার রাখার অনুরোধ করেন। শেখ হাসিনার রায় পড়া শেষ হলে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ ঘোষণা করা হয়। তখন কাউকে আর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। সাবেক আইজিপি মামুনকে এদিন আদালতে হাজির করা হয়। অনেকটা মাথা নিচু করে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় ঢোকেন তিনি। কাঠগড়ায় বিষণ্ন অবস্থায় ছিলেন তিনি। রায় শেষে তাকে আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয় কারাগারে।

এদিকে শেখ হাসিনার রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিমকোর্ট এলাকায় নেওয়া হয় কয়েক স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা। পুলিশ-র‌্যাব, এপিবিএন-বিজিবির পাশাপাশি নিয়োজিত করা হয় সেনাবাহিনীও। তৎপর দেখা যায় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদেরও। নিরাপত্তার স্বার্থে রোববার (১৬ নভেম্বর) সন্ধ্যার পর থেকে দোয়েল চত্বর হয়ে শিক্ষা ভবনমুখী সড়কে যান চলাচল বন্ধ রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সীমিত করা হয় জনসাধারণের চলাচলও।

যে অভিযোগে শেখ হাসিনার সাজা : প্রথম অভিযোগের অধীন তিনটি ঘটনায় শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রথম ঘটনা হচ্ছে উসকানি, দ্বিতীয়টি হত্যা করার আদেশ, তৃতীয়টি হচ্ছে নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে নিষ্ক্রিয়তা এবং দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতা, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুসারে শাস্তিযোগ্য। এ তিন ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হলো।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় তিনটি ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ সম্বোধন করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। একই দিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মাকসুদ কামালের সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথন আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলে তাদের ফাঁসি দেবে বলেন। যা উসকানি ও আদেশ দেন এবং অপরাধ সংঘটনে আসামিরা তার অধীন ব্যক্তিদের কোনো বাধা প্রদান করেননি। ফলে রংপুরে আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। এই তিনটি ঘটনায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, অনেক ঘটনা আছে। একটি হচ্ছে আন্দোলনকারীদের হত্যা করতে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও লেথাল উইপন ব্যবহারের আদেশ দিয়েছেন, যার মাধ্যমে তিনি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন করেছেন। শেখ হাসিনা একই ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছেন উল্লেখ করে রায়ে আরও বলা হয়, চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যা, যা সংঘটিত হয়েছে তার আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলে বর্ণনায় এসেছে। একইভাবে অন্য একটি ঘটনায় তিনি একই অপরাধ করেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ। এ কারণে আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘এই তিনটি ঘটনায় তাকে (শেখ হাসিনা) একটি সাজা প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেটি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ডের সাজা।’

যে অভিযোগে আসাদুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড : রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আসাদুজ্জামান খান কামাল মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ঢাকার চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনার জন্য। এ ঘটনার ক্ষেত্রে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে দায়ী সহযোগিতার জন্য এবং নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ ও প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার জন্য।

উভয় (চানখাঁরপুল ও আশুলিয়া) ক্ষেত্রে ছয়জন করে হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবব্যুনাল আইনের সংশ্লিষ্ট বিধানের অধীন আসাদুজ্জামান খান কামাল দায়ী বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, চানখাঁরপুল ও আশুলিয়ার ঘটনার ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতা। এসব ঘটনায় তাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

যে কারণে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–-মামুনের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড : চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ মামলার বিচারের ক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখেছেন পরিস্থিতি সম্পর্কে তার জানা সম্পূর্ণটা ও সত্য প্রকাশের মাধ্যমে। এমনকি তিনি স্বীকার করেছেন এবং তিনি ৩৬ দিনের আন্দোলনের সব ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। তার অবদান, স্বীকার করার সঙ্গে বস্তুগত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনায় তার সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে, যেখানে অপরাধের সম্পৃক্ততায় সর্বোচ্চ শাস্তি। কিন্তু তার অবদান বিবেচনায় নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড প্রদানের।

চৌধুরী মামুন জবানবন্দিতে বলেছিলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে সরাসরি ‘লেথাল উইপন’ (মারণাস্ত্র) ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছরের ১৮ জুলাই শেখ হাসিনার ওই নির্দেশনা তিনি পেয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মাধ্যমে। সোমবার রায়ের সময় শেখ হাসিনাসহ আসামিদের অপরাধের প্রমাণ হিসাবে আমলে নেওয়া ফোনালাপের রেকর্ড শোনানো হয়। জুলাই সহিংসতা নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিবেদনও উপস্থাপন করা হয়।

এছাড়া উসকানিমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য শেখ হাসিনাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ প্রমাণিত হওয়ায় শেখ হাসিনার এ শাস্তি হয়েছে। এখানে রংপুরে আবু সাঈদ হত্যার অভিযোগও আনা হয়েছে।

ছাত্র-জনতাকে রাজাকার বলে সম্বোধন করেন শেখ হাসিনা : আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে রাজাকার বলে সম্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এটা একটি উসকানিমূলক বক্তব্য। শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রসঙ্গে আদালত রায়ে বলেন, গত বছরের ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে রাজাকার বলে সম্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটা একটি উসকানিমূলক বক্তব্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে একই রাতে তিনি তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মাকসুদ কামালের সঙ্গে ফোনে আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের আদেশ দেন। এমনকি হত্যারও আদেশ দেন। ১৮ জুলাই ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ফোনে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে গুলি ও ড্রোনের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার অবস্থান নির্ণয়ের নির্দেশ দেন। রায় পাঠের সময় ঘুরেফিরে আসে শেখ হাসিনার র্বিভিন্ন ধরনের অডিও-ভিডিও ফোনালাপ। আসাদুজ্জামান কামালের বাসা থেকে কোর কমিটির মিটিংয়ের মাধ্যমে হাসিনার নির্দেশনা বাস্তবায়ন হতো। তার বিরুদ্ধে সাক্ষীদের জবানবন্দি এবং আলামত ও হত্যাকাণ্ডের নির্দেশসংক্রান্ত দালিলিক প্রমাণ হিসাবে এগুলো সাব্যস্ত হয়েছে।

রায়ের প্রতিক্রিয়া : রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, আজ বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি রায় হয়েছে। এই রায়ে শহীদরা ন্যায়বিচার পেয়েছেন, রাষ্ট্র ন্যায়বিচার পেয়েছে, প্রসিকিউশন ন্যায়বিচার পেয়েছে। শহীদদের প্রতি, দেশের প্রতি, এ দেশের মানুষের প্রতি, সংবিধানের প্রতি, আইনের শাসনের প্রতি এবং আগামী প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এ রায় যুগান্তকারী।

রায়ের পর ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, তারা যে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়েছেন পৃথিবীর যে কোনো আদালতে একই শাস্তি হতো। তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘যে ধরনের সাক্ষ্যপ্রমাণ এই আদালতে উপস্থাপিত হয়েছে, বিশ্বের যে কোনো আদালতের স্ট্যান্ডার্ডে এই সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো উতরে যাবে এবং পৃথিবীর যে কোনো আদালতে এই সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হলে আজ যেসব আসামিকে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই একই শাস্তিপ্রাপ্ত হবেন।’ ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ের প্রক্রিয়া সমাপ্ত হওয়ার পর সন্তোষ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শহীদ পরিবার, যাদের ক্ষতি কোনো কিছু দিয়ে পূরণ হবে না, তাদের সামনে অন্তত একটা ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছি। এজন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ সব আন্তর্জাতিক নর্মস, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করে ক্রাইমস এগেন্স হিউম্যানিটির মতো কমপ্লেক্স (মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো জটিল) অপরাধের বিচার করতে সক্ষম এবং বাংলাদেশ সাফল্যের সঙ্গে সেটা করেছে।’ তিনি বলেন, ‘অপরাধী যতই ক্ষমতাশালী হোক, সে আইনের ঊর্ধ্বে নয়। বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে যত বড় অপরাধীই হোক, তার অপরাধের জন্য তাকে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে এবং তার প্রাপ্য শাস্তি পেতে হবে।’

রায়ের পর প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম গণমাধ্যমকে বলেন, তিন আসামির বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। পাঁচটি অভিযোগকে ছয়টি কাউন্টে (ঘটনা বা বিষয়) ভাগ করে দুটি অভিযোগ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড এবং আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া যায়। অপরাধের নৃশংসতা, গুরুত্ব ও গভীরতা বিবেচনায় তিনটি কাউন্টে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড এবং অপর তিনটি কাউন্টে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দুটি অভিযোগেই চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি রাজসাক্ষী হয়েছেন, তিনি মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য, তবে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন এবং তার দেওয়া সাক্ষ্য ট্রাইব্যুনালের সঠিক রায় বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করেছে-এসব দিক বিবেচনায়।

মৃত্যুদণ্ডের সাজা পাওয়ায় কষ্ট অনুভব করছি : পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে এই মামলায় রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন মো. আমির হোসেন। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, মৃত্যুদণ্ডের সাজা পাওয়ায় কষ্ট অনুভব করছি। সোমবার রায় ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। আমির হোসেন বলেন, আমার ক্লায়েন্টের (হাসিনা-কামাল) বিরুদ্ধে রায়টা ভিন্নভাবে হলেও হতে পারত। কিন্তু হয়নি। এটা আমার বিপক্ষে গেছে। এজন্য আমি কষ্ট পাচ্ছি। কারণ আমার পক্ষে এ মামলায় আপিল করার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আত্মসমর্পণ না করবেন কিংবা গ্রেফতার হবেন।

প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গত ১ জুন ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। ফরমাল চার্জ দাখিলের মাধ্যমে ‘মিসকেস’ আনুষ্ঠানিকভাবে মামলায় রূপ নেয়। গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনে ১৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশদান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট পাঁচ অভিযোগে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। সেদিনই (১০ জুলাই) সাবেক আইজিপি মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন। গত ৩ আগস্ট এ মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এর মধ্য দিয়ে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। সূচনা বক্তব্য টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সূচনা বক্তব্যের পর এই মামলায় প্রথম সাক্ষী হিসাবে জবানবন্দি দেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গুরুতর আহত হওয়া খোকন চন্দ্র বর্মণ। তার সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। এ মামলায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ মোট ৫৪ জন সাক্ষী জবানবন্দি দেন। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় গত ৮ অক্টোবর। এরপর যুক্তিতর্ক শুরু হয় গত ১২ অক্টোবর, যা শেষ হয় ২৩ অক্টোবর। সবশেষ ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল জানান, ১৭ নভেম্বর (আজ) এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। ‘মিসকেস’ থেকে এ মামলার রায় ঘোষণা পর্যন্ত সময় লেগেছে ৩৯৭ দিন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম ও হত্যার ঘটনায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারও গুরুত্ব পাচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মোট চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় হলো। এছাড়া ২০১৩ সালের মে মাসে মতিঝিলের শাপলা চত্বরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামি করা হয়েছে ২১ জনকে। এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় বাড়িয়ে ১২ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনকালে গুমের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা দুটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামি ২৮ জন। আসামিদের মধ্যে সাবেক ও বর্তমান ২৩ জন সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন। এই দুটি মামলার পরবর্তী শুনানি ২৩ নভেম্বর।

আপলোডকারীর তথ্য

Rudra Kantho24

পলাতক ফ্যাসিস্ট হাসিনার মৃত্যুদণ্ড

পলাতক ফ্যাসিস্ট হাসিনার মৃত্যুদণ্ড

আপডেট সময় ০৮:৫৩:০৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫

অবিশ্বাস্য এক ঘটনা ঘটল বাংলাদেশে। টানা সাড়ে ১৫ বছরের অপশাসনে শেখ হাসিনার কখনো মনে হয়নি, জীবনে তাকে এমন এক পরিণতি বরণ করতে হবে। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে সেই ঘটনাই ঘটেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে ভারতে পলাতক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। একই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আরেক আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) রাজসাক্ষী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দেওয়া হয়েছে ৫ বছরের লঘুদণ্ড। রায়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি যারা ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের কনসিডারেবল অ্যামাউন্ট (উল্লেখযোগ্য পরিমাণ) আন্দোলনকারীদের ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া আহত আন্দোলনকারীদের আঘাতের মাত্রা ও ক্ষতি বিবেচনায় পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে রায়ে।

সোমবার দুপুরে জনাকীর্ণ আদালতে বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সোমবার এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণা উপলক্ষ্যে জুলাই শহীদপরিবারের সদস্য এবং আহতদের বেশ কয়েকজন ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। রায়ে শেখ হাসিনার ফাঁসির আদেশ শুনে আলহামদুলিল্লাহ বলে সন্তোষ প্রকাশ করেন তারা। শহীদ আনাসের মা সন্তানের স্মৃতি মনে করে কেঁদে ফেলেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, এটি যুগান্তকারী রায়। ভারত থেকে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন জুলাই যোদ্ধাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। তারা চৌধুরী মামুনের সাজা কম হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক থাকায় রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিলের সুযোগ পাচ্ছেন না। আপিল করতে হলে তাদের ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করতে হবে। শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবীও বলেছেন, আইনে না থাকায় তার আসামির আপিলের সুযোগ নেই।

জুলাই আন্দোলনে ১৪০০ ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে করা কোনো মামলায় এটিই প্রথম রায়। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

জনগণকে জিম্মি করে স্বৈরাচারী কায়দায় সাড়ে ১৫ বছর দেশে শাসনের নামে পরিবারতন্ত্র কায়েক করেছিলেন শেখ হাসিনা। তার আশপাশে গড়ে তোলেন চাটুকার বাহিনী। তাদের সবার স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন জনগণের প্রতিপক্ষ। কিন্তু তার গুম-খুন বাহিনীর ভয়ে কেউ তার অপশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে পরত না। ২০২৪ সালের আমি আর ডামি নির্বচনের মধ্য দিয়ে একদলীয় শাসনের চূড়ান্ত নীলনকশা নতুন প্রজন্ম ও ছাত্রছাত্রীরা বুঝতে পেরে তারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোটা সংস্কার আন্দোলন ইস্যুতে মাঠে নামে। শেষ পর্যন্ত টানা ৩৬ দিনের আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তিনি কোনো মতে ভারতে পালিয়ে গিয়ে নিজের জীবন রক্ষা করেন। তার সঙ্গে ছোট বোন শেখ রেহানাও পালিয়ে যান। শেখ হাসিনা ভারতে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন বলে রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ করে আসছে। তার বিরুদ্ধে জুলাই গণহত্যার রায় যত এগিয়ে আসছিল, তিনি ততই বেপরোয়া আচরণ শুরু করেন। তার নির্দেশে দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত দলটির কিছু দুষ্কৃতকারী কর্মী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর অবস্থানে থাকায় তারা সুবিধা করতে পারেনি। এমন বাস্তবতায় সোমবার দেওয়া হলো ঐতিহাসিক সেই রায়। যার জন্য দেশবাসী ৫ আগস্টের পর থেকে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় ছিলেন।

শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রথম সাবেক সরকারপ্রধান, যার মাথার ওপর এখন ঝুলছে মৃত্যুদণ্ডের রায়। এর আগে আর কোনো সরকারপ্রধানকে এভাবে গণহত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ডের মুখে পড়তে হয়নি কোনো আদালত থেকেই। এবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকেই শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ সাজার রায় এলো, যে আদালত তার সরকার গঠন করেছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে ভিন্নমতের রাজনীতির মুখ বন্ধ করার জন্য।

সোমবার বেলা সাড়ে ১২টায় জনাকীর্ণ আদালতে রায় পড়া শুরু হয়। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেনসহ আইনজীবী, শহীদপরিবারের সদস্য, আহত ও পঙ্গু জুলাই যোদ্ধা এবং বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকর্মী উপস্থিত ছিলেন। দণ্ড ঘোষণার মধ্য দিয়ে বেলা ২টা ৫৪ মিনিটে ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায় পড়া শেষ হয়। রায়ের কার্যক্রম বিটিভির মাধ্যমে সরাসরি সব টিভি চ্যানেল প্রচার করে।

ঘোষিত এ রায়ে মোট ছয়টি অংশ ছিল। ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় সদস্য বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী এবং প্রথম সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ রায়ের দুটি অংশ পড়ে শোনান। সবশেষে আসামিদের সাজার বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার। বিচারক শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করতেই এজলাসে উপস্থিত অনেকেই হাততালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান তখন ডায়াসে যান এবং সবাইকে ট্রাইব্যুনালের সুষ্ঠু পরিবেশ বজার রাখার অনুরোধ করেন। শেখ হাসিনার রায় পড়া শেষ হলে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ ঘোষণা করা হয়। তখন কাউকে আর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। সাবেক আইজিপি মামুনকে এদিন আদালতে হাজির করা হয়। অনেকটা মাথা নিচু করে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় ঢোকেন তিনি। কাঠগড়ায় বিষণ্ন অবস্থায় ছিলেন তিনি। রায় শেষে তাকে আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয় কারাগারে।

এদিকে শেখ হাসিনার রায়কে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিমকোর্ট এলাকায় নেওয়া হয় কয়েক স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা। পুলিশ-র‌্যাব, এপিবিএন-বিজিবির পাশাপাশি নিয়োজিত করা হয় সেনাবাহিনীও। তৎপর দেখা যায় গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদেরও। নিরাপত্তার স্বার্থে রোববার (১৬ নভেম্বর) সন্ধ্যার পর থেকে দোয়েল চত্বর হয়ে শিক্ষা ভবনমুখী সড়কে যান চলাচল বন্ধ রাখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সীমিত করা হয় জনসাধারণের চলাচলও।

যে অভিযোগে শেখ হাসিনার সাজা : প্রথম অভিযোগের অধীন তিনটি ঘটনায় শেখ হাসিনাকে দোষী সাব্যস্ত করে রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, প্রথম ঘটনা হচ্ছে উসকানি, দ্বিতীয়টি হত্যা করার আদেশ, তৃতীয়টি হচ্ছে নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধে নিষ্ক্রিয়তা এবং দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতা, যা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুসারে শাস্তিযোগ্য। এ তিন ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হলো।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় তিনটি ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ সম্বোধন করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। একই দিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মাকসুদ কামালের সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথন আন্দোলনকারীদের রাজাকার বলে তাদের ফাঁসি দেবে বলেন। যা উসকানি ও আদেশ দেন এবং অপরাধ সংঘটনে আসামিরা তার অধীন ব্যক্তিদের কোনো বাধা প্রদান করেননি। ফলে রংপুরে আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। এই তিনটি ঘটনায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, অনেক ঘটনা আছে। একটি হচ্ছে আন্দোলনকারীদের হত্যা করতে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও লেথাল উইপন ব্যবহারের আদেশ দিয়েছেন, যার মাধ্যমে তিনি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটন করেছেন। শেখ হাসিনা একই ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছেন উল্লেখ করে রায়ে আরও বলা হয়, চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যা, যা সংঘটিত হয়েছে তার আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলে বর্ণনায় এসেছে। একইভাবে অন্য একটি ঘটনায় তিনি একই অপরাধ করেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ। এ কারণে আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘এই তিনটি ঘটনায় তাকে (শেখ হাসিনা) একটি সাজা প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেটি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ডের সাজা।’

যে অভিযোগে আসাদুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড : রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আসাদুজ্জামান খান কামাল মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী ঢাকার চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনার জন্য। এ ঘটনার ক্ষেত্রে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে দায়ী সহযোগিতার জন্য এবং নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ ও প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার জন্য।

উভয় (চানখাঁরপুল ও আশুলিয়া) ক্ষেত্রে ছয়জন করে হত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবব্যুনাল আইনের সংশ্লিষ্ট বিধানের অধীন আসাদুজ্জামান খান কামাল দায়ী বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, চানখাঁরপুল ও আশুলিয়ার ঘটনার ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটনে সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতা। এসব ঘটনায় তাকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

যে কারণে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–-মামুনের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড : চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ মামলার বিচারের ক্ষেত্রে তিনি অবদান রেখেছেন পরিস্থিতি সম্পর্কে তার জানা সম্পূর্ণটা ও সত্য প্রকাশের মাধ্যমে। এমনকি তিনি স্বীকার করেছেন এবং তিনি ৩৬ দিনের আন্দোলনের সব ঘটনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। তার অবদান, স্বীকার করার সঙ্গে বস্তুগত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনায় তার সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে, যেখানে অপরাধের সম্পৃক্ততায় সর্বোচ্চ শাস্তি। কিন্তু তার অবদান বিবেচনায় নিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড প্রদানের।

চৌধুরী মামুন জবানবন্দিতে বলেছিলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে সরাসরি ‘লেথাল উইপন’ (মারণাস্ত্র) ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছরের ১৮ জুলাই শেখ হাসিনার ওই নির্দেশনা তিনি পেয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মাধ্যমে। সোমবার রায়ের সময় শেখ হাসিনাসহ আসামিদের অপরাধের প্রমাণ হিসাবে আমলে নেওয়া ফোনালাপের রেকর্ড শোনানো হয়। জুলাই সহিংসতা নিয়ে জাতিসংঘ প্রতিবেদনও উপস্থাপন করা হয়।

এছাড়া উসকানিমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য শেখ হাসিনাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ প্রমাণিত হওয়ায় শেখ হাসিনার এ শাস্তি হয়েছে। এখানে রংপুরে আবু সাঈদ হত্যার অভিযোগও আনা হয়েছে।

ছাত্র-জনতাকে রাজাকার বলে সম্বোধন করেন শেখ হাসিনা : আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে রাজাকার বলে সম্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এটা একটি উসকানিমূলক বক্তব্য। শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রসঙ্গে আদালত রায়ে বলেন, গত বছরের ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে রাজাকার বলে সম্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটা একটি উসকানিমূলক বক্তব্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে একই রাতে তিনি তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মাকসুদ কামালের সঙ্গে ফোনে আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের আদেশ দেন। এমনকি হত্যারও আদেশ দেন। ১৮ জুলাই ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ফোনে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে গুলি ও ড্রোনের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার অবস্থান নির্ণয়ের নির্দেশ দেন। রায় পাঠের সময় ঘুরেফিরে আসে শেখ হাসিনার র্বিভিন্ন ধরনের অডিও-ভিডিও ফোনালাপ। আসাদুজ্জামান কামালের বাসা থেকে কোর কমিটির মিটিংয়ের মাধ্যমে হাসিনার নির্দেশনা বাস্তবায়ন হতো। তার বিরুদ্ধে সাক্ষীদের জবানবন্দি এবং আলামত ও হত্যাকাণ্ডের নির্দেশসংক্রান্ত দালিলিক প্রমাণ হিসাবে এগুলো সাব্যস্ত হয়েছে।

রায়ের প্রতিক্রিয়া : রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, আজ বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি রায় হয়েছে। এই রায়ে শহীদরা ন্যায়বিচার পেয়েছেন, রাষ্ট্র ন্যায়বিচার পেয়েছে, প্রসিকিউশন ন্যায়বিচার পেয়েছে। শহীদদের প্রতি, দেশের প্রতি, এ দেশের মানুষের প্রতি, সংবিধানের প্রতি, আইনের শাসনের প্রতি এবং আগামী প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এ রায় যুগান্তকারী।

রায়ের পর ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, তারা যে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়েছেন পৃথিবীর যে কোনো আদালতে একই শাস্তি হতো। তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনে তাজুল ইসলাম বলেন, ‘যে ধরনের সাক্ষ্যপ্রমাণ এই আদালতে উপস্থাপিত হয়েছে, বিশ্বের যে কোনো আদালতের স্ট্যান্ডার্ডে এই সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো উতরে যাবে এবং পৃথিবীর যে কোনো আদালতে এই সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হলে আজ যেসব আসামিকে শাস্তি প্রদান করা হয়েছে, তারা প্রত্যেকেই একই শাস্তিপ্রাপ্ত হবেন।’ ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ের প্রক্রিয়া সমাপ্ত হওয়ার পর সন্তোষ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শহীদ পরিবার, যাদের ক্ষতি কোনো কিছু দিয়ে পূরণ হবে না, তাদের সামনে অন্তত একটা ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পেরেছি। এজন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।

মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ সব আন্তর্জাতিক নর্মস, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করে ক্রাইমস এগেন্স হিউম্যানিটির মতো কমপ্লেক্স (মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো জটিল) অপরাধের বিচার করতে সক্ষম এবং বাংলাদেশ সাফল্যের সঙ্গে সেটা করেছে।’ তিনি বলেন, ‘অপরাধী যতই ক্ষমতাশালী হোক, সে আইনের ঊর্ধ্বে নয়। বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে যত বড় অপরাধীই হোক, তার অপরাধের জন্য তাকে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে এবং তার প্রাপ্য শাস্তি পেতে হবে।’

রায়ের পর প্রসিকিউটর গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম গণমাধ্যমকে বলেন, তিন আসামির বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। পাঁচটি অভিযোগকে ছয়টি কাউন্টে (ঘটনা বা বিষয়) ভাগ করে দুটি অভিযোগ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড এবং আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া যায়। অপরাধের নৃশংসতা, গুরুত্ব ও গভীরতা বিবেচনায় তিনটি কাউন্টে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড এবং অপর তিনটি কাউন্টে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দুটি অভিযোগেই চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি রাজসাক্ষী হয়েছেন, তিনি মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য, তবে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন এবং তার দেওয়া সাক্ষ্য ট্রাইব্যুনালের সঠিক রায় বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করেছে-এসব দিক বিবেচনায়।

মৃত্যুদণ্ডের সাজা পাওয়ায় কষ্ট অনুভব করছি : পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে এই মামলায় রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী ছিলেন মো. আমির হোসেন। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, মৃত্যুদণ্ডের সাজা পাওয়ায় কষ্ট অনুভব করছি। সোমবার রায় ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। আমির হোসেন বলেন, আমার ক্লায়েন্টের (হাসিনা-কামাল) বিরুদ্ধে রায়টা ভিন্নভাবে হলেও হতে পারত। কিন্তু হয়নি। এটা আমার বিপক্ষে গেছে। এজন্য আমি কষ্ট পাচ্ছি। কারণ আমার পক্ষে এ মামলায় আপিল করার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আত্মসমর্পণ না করবেন কিংবা গ্রেফতার হবেন।

প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গত ১ জুন ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। ফরমাল চার্জ দাখিলের মাধ্যমে ‘মিসকেস’ আনুষ্ঠানিকভাবে মামলায় রূপ নেয়। গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনে ১৪০০ জনকে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা ও নির্দেশদান, ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’ এবং ‘জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজের’ মোট পাঁচ অভিযোগে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। সেদিনই (১০ জুলাই) সাবেক আইজিপি মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন। গত ৩ আগস্ট এ মামলায় সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এর মধ্য দিয়ে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। সূচনা বক্তব্য টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। সূচনা বক্তব্যের পর এই মামলায় প্রথম সাক্ষী হিসাবে জবানবন্দি দেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গুরুতর আহত হওয়া খোকন চন্দ্র বর্মণ। তার সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। এ মামলায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ মোট ৫৪ জন সাক্ষী জবানবন্দি দেন। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় গত ৮ অক্টোবর। এরপর যুক্তিতর্ক শুরু হয় গত ১২ অক্টোবর, যা শেষ হয় ২৩ অক্টোবর। সবশেষ ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল জানান, ১৭ নভেম্বর (আজ) এ মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। ‘মিসকেস’ থেকে এ মামলার রায় ঘোষণা পর্যন্ত সময় লেগেছে ৩৯৭ দিন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম ও হত্যার ঘটনায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারও গুরুত্ব পাচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মোট চারটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় হলো। এছাড়া ২০১৩ সালের মে মাসে মতিঝিলের শাপলা চত্বরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামি করা হয়েছে ২১ জনকে। এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় বাড়িয়ে ১২ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনকালে গুমের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা দুটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামি ২৮ জন। আসামিদের মধ্যে সাবেক ও বর্তমান ২৩ জন সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন। এই দুটি মামলার পরবর্তী শুনানি ২৩ নভেম্বর।