গত বছরের জুলাই মাসে কোটাবিরোধী আন্দোলন দমনে চারটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার সাময়িকভাবে বন্ধ করতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে তিনি এ নির্দেশনা দেন। এরপর ১৮ জুলাই সন্ধ্যা ৬টা ৫ মিনিট থেকে ৬টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত বন্ধ থাকে বেসরকারি টেলিভিশন দেশ টিভির সম্প্রচার। একইসঙ্গে প্রায় ৩০ মিনিট করে বন্ধ করা হয়েছিল বাংলাভিশন, চ্যানেল ২৪ ও এনটিভির সম্প্রচারও।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কোম্পানি (বিএসসিএল) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ ছাড়া মোহাম্মদ আলী আরাফাত ও বিএসসিএলের সাবেক চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদের হোয়াটসঅ্যাপ খুদে বার্তা থেকেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে।
দুজনের কথোপকথনের একটি স্ক্রিনশট আসে সময়ের আলোর হাতে। তাতে দেখা যায়, ১৮ জুলাই দুপুর ১২টা ৫৭ মিনিটে ড. শাহজাহান মাহমুদকে ফোন করেন মোহাম্মদ আরাফাত। এ সময় ড. শাহজাহান মাহমুদ ফোন ধরেননি। এরপর দুপুর ১টা ১ মিনিটে ড. শাহজাহানকে একটি মেসেজ দেন আরাফাত। মেসেজে তিনি লেখেন-‘দেশ টিভি উইল গো অফ দ্য এয়ার ফ্রম ১৩.১০ পিএম ফর ১০ মিনিটস। প্লিজ কনর্ফাম ইফ ইউ গেট দিস মেসেজ, ‘রিগার্ডস এসএম’ জবাবে ১টা ১১ মিনিটে ড. শাহজাহান লেখেন ‘ইয়েস’। এরপর ১টা ৩৩ মিনিটে আরাফাত আরও একটি মেসেজ দেন। সেখানে তিনি লেখেন-‘উই টার্নড ইট অন এগেইন আফটার ১৫ মিনিটস, আকাশ সাবস্ক্রাইবারস এ ‘মেকানিক্যাল ফলট’ নোটিস আদারস ওয়াচড এ পাসড স্ক্রিন’। পরে ১টা ৩৭ মিনিটে ড. শাহজাহান রিপ্লাইতে লেখেন-‘পারফেক্ট’। তার এ নির্দেশের পর দেশ টিভি, চ্যানেল ২৪, এনটিভি ও বাংলাভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার প্রায় ৩০ মিনিট বন্ধ রাখে বিএসসিএল। পরে আবার চ্যানেলগুলোতে সম্প্রচার সংযোগ দেওয়া হয়। মূলত ১৭ জুলাই সারা দেশে কোটা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে তা নিয়ন্ত্রণে দমন-পীড়ন শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ওই দিন অনেক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এরপর ১৮ জুলাই আন্দোলন আরও বেগবান হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত আন্দোলনে দমন-পীড়ন ও সহিংসতা লুকাতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। আর এ কাজে সহায়তা করেছিলেন বিএসসিএলের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয় ও বিপণন) শাহ আহমেদুল কবির সময়ের আলোকে বলেন, বিগত জুলাই আগস্টের আন্দোলন চলাকালে চারটি চ্যানেলের সম্প্রচার সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল। এরমধ্যে ১৮ জুলাই সন্ধ্যা ৬টা ৫ মিনিট থেকে ৬টা ২৫ মিনিট পর্যন্ত দেশ টিভির সম্প্রচার বন্ধ ছিল। শুনেছি বাকি তিনটি চ্যানেলও ৩০ মিনিট করে সম্প্রচার বন্ধ ছিল। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। গ্রাহকের সঙ্গে কোম্পানির যেই চুক্তি থাকে, একমাত্র সেই চুক্তির ব্যত্যয় ঘটলেই কেবল সেবা বিচ্ছিন্ন করার বিধান রয়েছে। ওই সময়ে এ চারজন গ্রাহকের সঙ্গে আমাদের এমন কোনো ইস্যু ছিল না। আমরা শুনেছি, ওপরের মহলের নির্দেশে তৎকালীন চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি তার অবস্থান পরিষ্কার করতে পারবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. শাহজাহান মাহমুদ সময়ের আলোকে বলেন, ওটা রাষ্ট্রের বিষয় তো, আমরা কিছু করতে পারি না। আমরা হুকুমের দাস। আমি রাজনীতিবিদ না, প্রশাসনের কেউ না, আমি টেকনিক্যাল লোক।
সেদিন আরাফত কী বলেছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওইটা বলে তো এখন লাভ নেই। আরাফাত তখন তথ্যমন্ত্রী, উনি তখন সব টেলিভিশনের চার্জে, সবগুলো কিন্তু রাষ্ট্রের টেলিভিশন। তখন রাষ্ট্র যদি বলে সবগুলো টেলিভিশন বন্ধ করে দেন, আমাদের কোনো উপায় আছে? তবে রাষ্ট্র যদি সবগুলো ২৪ ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দিতে বলে সেখানে আমরা ২ মিনিট বা ৩ মিনিট কম্প্রোমাইজ করে বন্ধ করেছি। যখন এ রকম কোনো অর্ডার আসে তখন আমি কর্মকর্তাদের বলি দুই কূল রক্ষা করার জন্য। আমি কর্মকর্তাদের বলেছিলাম, তোমাদের চাকরির জন্য, আমাদের চাকরির জন্য জাস্ট সামান্য দেখিয়ে দাও। ১০ মিনিটের ওপরে বন্ধ ছিল না। আর যদি হয়ে থাকে তা হলে নির্দেশ ছিল হয়তো ১০ ঘণ্টা ১২ ঘণ্টার জন্য।
কী রকম চাপ ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি সব বলতে পারব না। শুধু ওইটা না, অন্য জায়গা থেকেও চাপ ছিল। ডিটেইলস আমি কিছু বলতে পারব না। রাষ্ট্রীয় কিছু ব্যাপার থাকে তো। পুরো টেলিভিশন সিস্টেমটা যেহেতু রাষ্ট্রের তাই রাষ্ট্রের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা চালাইছি।
অভিযোগ রয়েছে, চেয়ারম্যানের এ কাজের সহযোগী ছিলেন সদ্য পদোন্নতি পাওয়া উপ-মহাব্যাবস্থাপক (অপারেশনস) বখতিয়ার আহমেদ। তিনি অপারেশন হেড হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। চেয়ারম্যানের নির্দেশে তিনিই চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধ করেছিলেন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বখতিয়ার আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, আমার মাধ্যমে কিছু করা হয়নি। যেসব টিভি চ্যানেলের কনটেন্ট অপটিক্যাল ফাইবার হয়ে আমাদের গ্রাউন্ড স্টেশনে গেছে সেসব জায়গায় আমাদের সাবেক চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ স্যার অপটিক্যাল কোম্পনিকে (যাদু) বলে সম্প্রচার বন্ধ করেছে। তিনিই বন্ধের অনুমতি দিয়েছেন। ড. শাহজাহান মাহমুদ স্যার আমাদের যে ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান আছে ও অপটিক্যাল ফাইবার যে মেইনটেন করে যাদু ও সামিটের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেছেন। তাদের মাধ্যমেই সরাসরি শাহজাহান মাহমুদ স্যার এটা করেছেন। এটা চেয়ারম্যান ও তার ওপর (সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী) থেকে কন্ট্রোল করেছে। দেশ টিভিসহ দুয়েকটি চ্যানেল তিনি (ড. শাহজাহান মাহমুদ) সরাসরি বন্ধ করেছেন। আর কিছু জিনিস আছে যেটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ডিজিএফআই থেকে সরাসরি হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি তৈরি করেছে ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইটের ক্লাবে যুক্ত হয় বাংলাদেশের নাম। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট তৈরিতে ব্যয় হয়েছিল ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি স্যাটেলাইটের মালিকানা হস্তান্তর করা হয় নতুন কোম্পানি বিএসসিএলের কাছে। বিএসসিএল থেকে বর্তমানে সেবা নিচ্ছে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি মিলে ৪০টির মতো টেলিভিশন চ্যানেল। এসব টেলিভিশন থেকে মাসিক গড় আয় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা।
এ ছাড়া ভারতীয় চ্যানেল স্টার, সনি, জি নেটওয়ার্ক ও কালারস টিভি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে। এর বাইরে এয়ার কম মিডিয়া লিমিটেড, বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড, সিভিল অ্যাভিয়েশন অব বাংলাদেশ, মৎস্য অধিদফতর, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, বেক্সিমকো ডিজিটাল ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেড, স্কয়ার ইনফরমোটিক্স লিমিটেড, ইস্টার্ন ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক লিমিটেড, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, কার্নিভাল ইন্টারনেট ও টোটাল ব্রডকাস্টিং নেটওয়ার্ক এলএলসি (টিবিএন) বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে সেবা নিয়ে থাকে।