ঢাকা , বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ওষুধের দামে পিষ্ট রোগীরা

দেশে বিগত কয়েক বছর ধরেই ওষুধের মূল্য নির্ধারণে অব্যাহতভাবে চরম নৈরাজ্য চলছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে দাম। সেই ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও দফায় দফায় দাম বেড়েছে জীবনরক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধের। এতে একদিকে চিকিৎসার খরচ আর অন্যদিকে বেশিরভাগ ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় পিষ্ট হচ্ছেন রোগীরা।

বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট, ব্যথানাশক ট্যাবলেট, অ্যান্টিবায়োটিক, ডায়াবেটিস, ভিটামিন ও গ্যাস্ট্রিকসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে কাটছাঁট করে ওষুধ কিনে জীবন বাঁচাতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাসের মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির কমপক্ষে ৬০টিরও বেশি ওষুধের দাম বেড়েছে। ১০টি ওষুধের দাম গড়ে ৭৮ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১১০ শতাংশ বেড়েছে অ্যানাফ্লেক্স ম্যাক্স ট্যাবলেটের দাম। সর্বনিম্ন দাম বেড়েছে তিন শতাংশ। এ ছাড়াও অন্যান্য ওষুধের দামও ১০ শতাংশ থেকে শুরু করে ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। সরেজমিন রাজধানীর মিটফোর্ড, বংশাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা, শাহবাগ এবং পাড়া-মহল্লার একাধিক ফার্মেসি ও পাইকারি এবং খুচরা ওষুধ বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের। সবারই অভিযোগ -উৎপাদন ব্যয়ভারের নানা খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে ইচ্ছামতো প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম বাড়ানো হচ্ছে। মূলত ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা না থাকায়ই এবং যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থা না নেওয়ায় ব্যাপক হারে বাড়ছে ওষুধের দাম।
ওষুধ বিক্রেতারা বলেন, বিশেষ করে যারা নিয়মিত ওষুধ খান যেমন- ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং হাঁপানিজনিত সমস্যায় রোগীরা ওষুধ কিনতে এসে বাড়তি দামের কথা শুনে নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত করেন। তাদের সঙ্গে তর্কাতর্কি এবং ঝগড়া করতে হয়। অনেক সময় ক্রেতাদের কাছে জবাবদিহি করতে গিয়ে মার খাওয়ার উপক্রম হয়। আবার অনেক সময় কোম্পানিভেদে দামে ভিন্নতার কারণে অনেককেই নানা ধরনের বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়।

তবে ওষুধশিল্প সমিতি ও ওষুধ কোম্পানিগুলোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন, ওষুধের দাম খুব একটা বাড়েনি। কিছু কিছু ওষুধের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। তবে এসব ওষুধের দামের পেছনে ব্যাংক ঋণের সুদ বেশি, ডলার সংকট, ওষুধের কাঁচামালের বাড়তি দাম এবং গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিও উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে লাগামহীনভাবে বেড়েছে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম। বিশেষ করে জেনেরিকের জীবনরক্ষাকারী ওষুধের তালিকা না বাড়ার সুযোগ নিয়ে ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো দাম নিয়ন্ত্রণ করে। স্বাস্থ্যসেবা খাতে রোগীর খরচ হচ্ছে ৬৯ শতাংশ। ওষুধের দাম বৃদ্ধির কারণে চিকিৎসা ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে ওষুধ কেনার সামর্থ্য অনেকে হারাচ্ছেন। আবারও ওষুধের দাম বাড়লে দারিদ্র্যসীমা আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করেন তারা।

গত ৬ মাসের মধ্যে যেসব ওষুধের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে সেগুলো হলো- গ্যাস্ট্রিক ও আলসার এবং অস্টিওআর্থারাইটিস অ্যানাফ্লেক্স ম্যাক্স-৫০০ প্লাস (২০ মিলিগ্রাম) প্রতি পিস ট্যাবলেটের দাম ছিল ১০ টাকা। আর এখন বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ২১ টাকায়। বেড়েছে ১১০ শতাংশ। মাইগ্রেন জাতীয় সমস্যায় ফ্লুভার ১০ মি.গ্রা. ট্যাবলেটের ১০টির এক পাতার দাম ৩৫ থেকে বেড়ে ৭০ টাকা হয়েছে। বেড়েছে ১০০ শতাংশ। পেটের সমস্যাজনিত প্রোবায়ো ক্যাপসুলের দাম ১৪ টাকা থেকে বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৮৯ শতাংশ। চুলকানির রোগের জন্য ব্যবহৃত টেট্রাসল ২৫% সল্যুসনের ৩০ এমএল বোতলের দাম ছিল ৬৮ টাকা, যা বেড়ে এখন হয়েছে ১২৫ টাকা। অর্থাৎ বেড়েছে ৮৩ দশমিক ৮২ শতাংশ।

গ্যাসট্রিকের ওষুধ ফ্যামোট্যাক ২০ মি.গ্রা. ট্যাবলেট প্রতি প্যাকেট ৩০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৪০ টাকা। বেড়েছে ৮০ শতাংশ। অস্ত্রোপচার-পরবর্তী মাঝারি থেকে তীব্র ব্যথায় টোরাক্স-১০ প্রতি পিস বিক্রি হতো ১২ টাকায় আর এখন দাম বেড়ে হয়েছে ২০ টাকা। অর্থাৎ বেড়েছে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণজনিত সমস্যায় ভায়োডিন মাউথওয়াশ ৩০ টাকা থেকে ৫০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। গ্যাস্টিক সমস্যায় ফ্যামোম্যাক্স ৩০ থেকে বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। গ্যাস্ট্রিকের আরেক ক্যাপসুল ওমেপ এক পাতা ৭টির দাম ৩৫ টাকা বেড়ে ৫৬ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ বেড়েছে ৬০ শতাংশ। ভিটামিনজাতীয় ৩০টি ট্যাবলেটের বিভিন্ন কৌটা ২৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৬০ টাকা করা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। অর্থাৎ এই ১০টি ওষুধের দাম গড়ে ৭৮ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়াও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ মোক্সাসিল ১০০ এমএলের বোতল সিরাপ ৪৭ থেকে বেড়ে ৭০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। ভায়াল মেরোপেন ইনজেকশনের দাম ৭০০ টাকা বেড়ে ১০৪০ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ শতকরা হিসেবে বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

উচ্চ রক্তচাপের জন্য ৩০টির এক বক্স রসুভা (৫ এমজি) ট্যাবলেট ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করা হয়েছে। বেড়েছে ২০ শতাংশ। ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ব্যবহৃত এমজার্ড এম ট্যাবলেট ৫/৫০০ মি.গ্রা. প্রতি প্যাকেট ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৫৪০ টাকা হয়েছে। গ্লুভান প্লাস ৫০ মি.গ্রা. ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৭২০ টাকা, ফেবুক্সোস্ট্যাট ৪০ মি.গ্রা. ট্যাবলেট প্রতি পিস ১২ টাকা বেড়ে ১৫ টাকা হয়েছে। মূল্য বেড়েছে ২৫ শতাংশ। অ্যান্টিবায়োটিক ফ্লুক্লক্স ৫০০ মিলি গ্রাম ভায়ালের দাম ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিকের ট্যাবলেট রোজিথ ৫০০ মিলি গ্রামের প্রতি পিসের দাম ৩৫ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। ইউট্রোবিন ৫ মি.গ্রা. ট্যাবলেট প্রতি প্যাকেট ৪৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ ন্যাট্রিলিক্স এসআর ১.৫ মি.গ্রা. ২৭০ টাকা থেকে ৩৩০ টাকা বেড়েছে।
ঢাকা মাহুলটুলির বাসিন্দা রাশিদা বেগম (৪৫) ২০ বছর ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছেন। তার উচ্চ রক্তচাপ এবং কিডনি জটিলতাও রয়েছে। শুক্রবার বংশালের এক ফার্মেসিতে কথা হয় এ নারীর সঙ্গে। তিনি জানান, গত এক বছরে মধ্যে তার নিজের ওষুধের পেছনে খরচ আট থেকে ১০ হাজার টাকা বেড়েছে।
তিনি বলেন, আমার স্বামী নেই। ছেলের আয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাদের আয়ও খুব ভালো না। তাই টাকার অভাবে কখনো কখনো ওষুধ কিনতে পারি না। আবার মাঝেমধ্যে কাটছাঁট করে ওষুধ কিনে খাই।

আসাদ মিয়া নামে আরেক পেসারের রোগী বলেন, আমরা গরিব মানুষ। নুন আনতে পানতা ফুরায়। আবার বাজারে এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম চড়া। এর মধ্যে ওষুধের দাম বাড়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। যখন অবস্থা খুব খারাপ হয় তখন শুধু ওষুধ খাই। কি আর করব। এ ছাড়া তো টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ সময়ের আলোকে বলেন, ওষুধ হচ্ছে কর্মাশিয়াল প্রোডাক্ট। স্বাভাবিকভাবেই দাম বাড়বে। কিন্তু শুধু ওষুধের দাম নয়, ওষুধসহ রোগ শনাক্তের খরচের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বেড়েছে। তাতে করে অনেকেই ওষুধ কেনার সামর্থ্য অনেকে হারাচ্ছেন। ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধের দাম নির্ধারণে একটি আলাদা ব্যবস্থাপনা বা অথরিটি আছে। তাতে ওষুধের দাম নির্ধারণে গভর্মেন্ট কনসার্ট করেন। তারা ঠিক করেন কোন ওষুধের দাম কী হবে। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যতিক্রম। সবই ওষুধ প্রশাসন করে। আবার ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ধরনের নজরদারি প্রয়োজন তা নেই। আর এটি না থাকার কারণে কোম্পানিগুলো আইনের নানা ফাঁকফোকর দিয়ে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।

তিনি বলেন, ওষুধের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে কমিশন বাণিজ্য এবং ওষুধের বিজ্ঞাপন খরচ কমিয়ে বাড়তি দাম নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পাবে। সব ধরনের ওষুধের মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। তা না হলে কখনই দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে না।

ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো. আসরাফ হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। দাম বাড়াতে হলে কিছু নিয়ম-কানুন রয়েছে। কোম্পানি দাম বাড়ানোর আবেদন করলে তখন আইনগতভাবেই অনুমতি দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের বাড়তি দর ও কাঁচামাল ক্রয়ে ডলার সংকট ওষুধের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই কিছু কিছু কোম্পানির ওষুধের দাম সমন্বয় করা হয়েছে।

আপলোডকারীর তথ্য

Rudra Kantho24

জনপ্রিয় সংবাদ

ওষুধের দামে পিষ্ট রোগীরা

আপডেট সময় ১১:১৬:৪৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫

দেশে বিগত কয়েক বছর ধরেই ওষুধের মূল্য নির্ধারণে অব্যাহতভাবে চরম নৈরাজ্য চলছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে দাম। সেই ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও দফায় দফায় দাম বেড়েছে জীবনরক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধের। এতে একদিকে চিকিৎসার খরচ আর অন্যদিকে বেশিরভাগ ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় পিষ্ট হচ্ছেন রোগীরা।

বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট, ব্যথানাশক ট্যাবলেট, অ্যান্টিবায়োটিক, ডায়াবেটিস, ভিটামিন ও গ্যাস্ট্রিকসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে কাটছাঁট করে ওষুধ কিনে জীবন বাঁচাতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাসের মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানির কমপক্ষে ৬০টিরও বেশি ওষুধের দাম বেড়েছে। ১০টি ওষুধের দাম গড়ে ৭৮ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১১০ শতাংশ বেড়েছে অ্যানাফ্লেক্স ম্যাক্স ট্যাবলেটের দাম। সর্বনিম্ন দাম বেড়েছে তিন শতাংশ। এ ছাড়াও অন্যান্য ওষুধের দামও ১০ শতাংশ থেকে শুরু করে ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। সরেজমিন রাজধানীর মিটফোর্ড, বংশাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা, শাহবাগ এবং পাড়া-মহল্লার একাধিক ফার্মেসি ও পাইকারি এবং খুচরা ওষুধ বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের। সবারই অভিযোগ -উৎপাদন ব্যয়ভারের নানা খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে ইচ্ছামতো প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম বাড়ানো হচ্ছে। মূলত ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা না থাকায়ই এবং যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থা না নেওয়ায় ব্যাপক হারে বাড়ছে ওষুধের দাম।
ওষুধ বিক্রেতারা বলেন, বিশেষ করে যারা নিয়মিত ওষুধ খান যেমন- ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ এবং হাঁপানিজনিত সমস্যায় রোগীরা ওষুধ কিনতে এসে বাড়তি দামের কথা শুনে নানা প্রশ্নবানে জর্জরিত করেন। তাদের সঙ্গে তর্কাতর্কি এবং ঝগড়া করতে হয়। অনেক সময় ক্রেতাদের কাছে জবাবদিহি করতে গিয়ে মার খাওয়ার উপক্রম হয়। আবার অনেক সময় কোম্পানিভেদে দামে ভিন্নতার কারণে অনেককেই নানা ধরনের বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়।

তবে ওষুধশিল্প সমিতি ও ওষুধ কোম্পানিগুলোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন, ওষুধের দাম খুব একটা বাড়েনি। কিছু কিছু ওষুধের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। তবে এসব ওষুধের দামের পেছনে ব্যাংক ঋণের সুদ বেশি, ডলার সংকট, ওষুধের কাঁচামালের বাড়তি দাম এবং গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিও উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে লাগামহীনভাবে বেড়েছে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম। বিশেষ করে জেনেরিকের জীবনরক্ষাকারী ওষুধের তালিকা না বাড়ার সুযোগ নিয়ে ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো দাম নিয়ন্ত্রণ করে। স্বাস্থ্যসেবা খাতে রোগীর খরচ হচ্ছে ৬৯ শতাংশ। ওষুধের দাম বৃদ্ধির কারণে চিকিৎসা ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে ওষুধ কেনার সামর্থ্য অনেকে হারাচ্ছেন। আবারও ওষুধের দাম বাড়লে দারিদ্র্যসীমা আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করেন তারা।

গত ৬ মাসের মধ্যে যেসব ওষুধের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে সেগুলো হলো- গ্যাস্ট্রিক ও আলসার এবং অস্টিওআর্থারাইটিস অ্যানাফ্লেক্স ম্যাক্স-৫০০ প্লাস (২০ মিলিগ্রাম) প্রতি পিস ট্যাবলেটের দাম ছিল ১০ টাকা। আর এখন বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ২১ টাকায়। বেড়েছে ১১০ শতাংশ। মাইগ্রেন জাতীয় সমস্যায় ফ্লুভার ১০ মি.গ্রা. ট্যাবলেটের ১০টির এক পাতার দাম ৩৫ থেকে বেড়ে ৭০ টাকা হয়েছে। বেড়েছে ১০০ শতাংশ। পেটের সমস্যাজনিত প্রোবায়ো ক্যাপসুলের দাম ১৪ টাকা থেকে বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৮৯ শতাংশ। চুলকানির রোগের জন্য ব্যবহৃত টেট্রাসল ২৫% সল্যুসনের ৩০ এমএল বোতলের দাম ছিল ৬৮ টাকা, যা বেড়ে এখন হয়েছে ১২৫ টাকা। অর্থাৎ বেড়েছে ৮৩ দশমিক ৮২ শতাংশ।

গ্যাসট্রিকের ওষুধ ফ্যামোট্যাক ২০ মি.গ্রা. ট্যাবলেট প্রতি প্যাকেট ৩০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫৪০ টাকা। বেড়েছে ৮০ শতাংশ। অস্ত্রোপচার-পরবর্তী মাঝারি থেকে তীব্র ব্যথায় টোরাক্স-১০ প্রতি পিস বিক্রি হতো ১২ টাকায় আর এখন দাম বেড়ে হয়েছে ২০ টাকা। অর্থাৎ বেড়েছে ৬৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণজনিত সমস্যায় ভায়োডিন মাউথওয়াশ ৩০ টাকা থেকে ৫০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৬৭ শতাংশ। গ্যাস্টিক সমস্যায় ফ্যামোম্যাক্স ৩০ থেকে বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। গ্যাস্ট্রিকের আরেক ক্যাপসুল ওমেপ এক পাতা ৭টির দাম ৩৫ টাকা বেড়ে ৫৬ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ বেড়েছে ৬০ শতাংশ। ভিটামিনজাতীয় ৩০টি ট্যাবলেটের বিভিন্ন কৌটা ২৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৬০ টাকা করা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। অর্থাৎ এই ১০টি ওষুধের দাম গড়ে ৭৮ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়াও অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ মোক্সাসিল ১০০ এমএলের বোতল সিরাপ ৪৭ থেকে বেড়ে ৭০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। ভায়াল মেরোপেন ইনজেকশনের দাম ৭০০ টাকা বেড়ে ১০৪০ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ শতকরা হিসেবে বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

উচ্চ রক্তচাপের জন্য ৩০টির এক বক্স রসুভা (৫ এমজি) ট্যাবলেট ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা করা হয়েছে। বেড়েছে ২০ শতাংশ। ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ব্যবহৃত এমজার্ড এম ট্যাবলেট ৫/৫০০ মি.গ্রা. প্রতি প্যাকেট ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৫৪০ টাকা হয়েছে। গ্লুভান প্লাস ৫০ মি.গ্রা. ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৭২০ টাকা, ফেবুক্সোস্ট্যাট ৪০ মি.গ্রা. ট্যাবলেট প্রতি পিস ১২ টাকা বেড়ে ১৫ টাকা হয়েছে। মূল্য বেড়েছে ২৫ শতাংশ। অ্যান্টিবায়োটিক ফ্লুক্লক্স ৫০০ মিলি গ্রাম ভায়ালের দাম ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকা হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিকের ট্যাবলেট রোজিথ ৫০০ মিলি গ্রামের প্রতি পিসের দাম ৩৫ টাকা থেকে বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। ইউট্রোবিন ৫ মি.গ্রা. ট্যাবলেট প্রতি প্যাকেট ৪৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ ন্যাট্রিলিক্স এসআর ১.৫ মি.গ্রা. ২৭০ টাকা থেকে ৩৩০ টাকা বেড়েছে।
ঢাকা মাহুলটুলির বাসিন্দা রাশিদা বেগম (৪৫) ২০ বছর ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছেন। তার উচ্চ রক্তচাপ এবং কিডনি জটিলতাও রয়েছে। শুক্রবার বংশালের এক ফার্মেসিতে কথা হয় এ নারীর সঙ্গে। তিনি জানান, গত এক বছরে মধ্যে তার নিজের ওষুধের পেছনে খরচ আট থেকে ১০ হাজার টাকা বেড়েছে।
তিনি বলেন, আমার স্বামী নেই। ছেলের আয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাদের আয়ও খুব ভালো না। তাই টাকার অভাবে কখনো কখনো ওষুধ কিনতে পারি না। আবার মাঝেমধ্যে কাটছাঁট করে ওষুধ কিনে খাই।

আসাদ মিয়া নামে আরেক পেসারের রোগী বলেন, আমরা গরিব মানুষ। নুন আনতে পানতা ফুরায়। আবার বাজারে এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম চড়া। এর মধ্যে ওষুধের দাম বাড়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। যখন অবস্থা খুব খারাপ হয় তখন শুধু ওষুধ খাই। কি আর করব। এ ছাড়া তো টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ সময়ের আলোকে বলেন, ওষুধ হচ্ছে কর্মাশিয়াল প্রোডাক্ট। স্বাভাবিকভাবেই দাম বাড়বে। কিন্তু শুধু ওষুধের দাম নয়, ওষুধসহ রোগ শনাক্তের খরচের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বেড়েছে। তাতে করে অনেকেই ওষুধ কেনার সামর্থ্য অনেকে হারাচ্ছেন। ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধের দাম নির্ধারণে একটি আলাদা ব্যবস্থাপনা বা অথরিটি আছে। তাতে ওষুধের দাম নির্ধারণে গভর্মেন্ট কনসার্ট করেন। তারা ঠিক করেন কোন ওষুধের দাম কী হবে। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যতিক্রম। সবই ওষুধ প্রশাসন করে। আবার ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ধরনের নজরদারি প্রয়োজন তা নেই। আর এটি না থাকার কারণে কোম্পানিগুলো আইনের নানা ফাঁকফোকর দিয়ে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।

তিনি বলেন, ওষুধের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে কমিশন বাণিজ্য এবং ওষুধের বিজ্ঞাপন খরচ কমিয়ে বাড়তি দাম নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পাবে। সব ধরনের ওষুধের মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। তা না হলে কখনই দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে না।

ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো. আসরাফ হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। দাম বাড়াতে হলে কিছু নিয়ম-কানুন রয়েছে। কোম্পানি দাম বাড়ানোর আবেদন করলে তখন আইনগতভাবেই অনুমতি দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের বাড়তি দর ও কাঁচামাল ক্রয়ে ডলার সংকট ওষুধের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই কিছু কিছু কোম্পানির ওষুধের দাম সমন্বয় করা হয়েছে।