জুলাই আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক বছর ঘুরতেই অনেকটাই হুট করে বেশ কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। চালসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন গড়পড়তা আয়ের মানুষ। স্বস্তিতে নেই মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও। কম দামে নিত্যপণ্য কিনতে এখন অনেককেই ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকের পেছনে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। শুধু দিনমজুর, স্বল্প আয়ের মানুষ বা নিম্নবিত্ত পরিবারই নয়, শহরে বসবাস করা মধ্যবিত্তদেরও এখন এই লাইনে দেখা যাচ্ছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, টিসিবির লাইনে এখন দিনমজুর, স্বল্প আয়ের মানুষ বা নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের পাশাপাশি রাজধানীতে বসবাসকারী বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেসে থাকা শিক্ষার্থীরাও দাঁড়িয়েছেন স্বল্পমূল্যে পণ্য কিনতে। রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন দৃশ্য এখন খুবই স্বাভাবিক বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোদ টিসিবির হিসাবই বলছে, এক বছরের ব্যবধানে এখন বাজারে বেশিরভাগ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। টিসিবির দেওয়া ১২ আগস্টের বাজার দরের তালিকা অনুযায়ী, ৩৩টি পণ্যের মধ্যে এক বছর ব্যবধানে ১৭টি পণ্যের দাম বেড়েছে। আর স্থিতিশীল রয়েছে একটি পণ্যের দাম। ১৫টি পণ্যের দাম কমেছে।
জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় বাজারে বেড়েছে চাল, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল (সয়াবিন, পাম, রাইসব্র্যান), মসুর ডাল, মাছ, গরু ও খাসির মাংস, মুরগি, গুঁড়োদুধের দাম। এসব একটি পরিবারের নিত্যদিনের বড় খরচের তালিকায় থাকে। এ ছাড়া বাড়তি তালিকায় রয়েছে তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় খেজুর, হলুদ, এলাচ, তেজপাতা ও লেখার কাগজের দাম। এমএস রড ও লেখার কাগজ, এ দুটি পণ্যের দাম খাদ্যপণ্যের বাইরে নিয়মিত হিসেবে রাখে টিসিবি।
এদিকে গত ১০ আগস্ট (রবিবার) থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও কুমিল্লা মহানগরীসহ বেশ কয়েকটি জেলায় নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে তাদের পণ্য বিক্রি কার্যক্রম শুরু করছে টিসিবি। যা তার আগের দিন শনিবার (৯ আগস্ট) এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেশের গণমাধ্যমকে জানিয়েছে সংস্থাটি।
টিসিবির উপপরিচালক শাহাদাত হোসেনের সই করা ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১০ আগস্ট থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩০ দিন (শুক্রবার ছাড়া) ঢাকায় এ পণ্য বিক্রি চলবে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২৫টি, গাজীপুর মহানগরীতে ছয়টি, কুমিল্লা মহানগরীতে তিনটি এবং ঢাকা জেলায় আটটি, কুমিল্লা জেলায় ১২টি, ফরিদপুর জেলায় চারটি, পটুয়াখালী জেলায় পাঁচটি ও বাগেরহাট জেলায় পাঁচটি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ১০ থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১৯ দিন (শুক্রবার ছাড়া) টিসিবির পণ্য বিক্রি করা হবে। প্রতিদিন একটি ট্রাক থেকে ৫০০ মানুষের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্যাদি (ভোজ্যতেল, চিনি ও মসুর ডাল) বিক্রি হবে। যেকোনও ভোক্তা ট্রাক থেকে এসব পণ্য কিনতে পারবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপ ও স্মার্ট ফ্যামিলি কার্ড সক্রিয় না হওয়ায় দীর্ঘদিন স্থবিরতা চলেছে টিসিবির এই পণ্য বিক্রি কার্যক্রমে। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় নিম্নবিত্তসহ মধ্যবিত্ত পরিবারেও টিসিবি পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। দীর্ঘদিন পর সরকারের এই কার্যক্রম শুরু হওয়ায় বেড়েছে টিসিবির ট্রাকের সামনে ক্রেতাদের ভিড়। রমজান ও কোরবানির ঈদের সময় ট্রাকে পণ্য বিক্রির পর সাময়িক বিরতি দিয়ে আবারও নতুন করে ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কার্যক্রম শুরু করছে সংস্থাটি। ট্রাক থেকে প্রতিজন ভোক্তা সর্বোচ্চ দুই লিটার তেল, দুই কেজি মসুর ডাল ও এক কেজি চিনি কিনতে পারবেন।
পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে, সয়াবিন বা রাইসব্র্যান তেল ১১৫ টাকা প্রতি লিটার, মসুর ডাল ৭০ টাকা প্রতিকেজি, চিনি ৮০ টাকা প্রতিকেজি।
টিসিবি জানিয়েছে, ঢাকা মহানগরীতে ৬০টি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে ১০ আগস্ট থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (শুক্রবার ছাড়া) টানা ৩০ দিন পণ্য বিক্রি চলবে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, গাজীপুর, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহানগরীতে ট্রাকের মাধ্যমে একইভাবে ১০ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১৯ দিনব্যাপী পণ্য বিক্রি করা হবে। ক্রেতা পণ্য পাবেন ‘আগে আসলে আগে পাবেন’ ভিত্তিতে।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত প্রায় ৬৫ লাখ পরিবারের কাছে স্মার্ট কার্ড সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে সক্রিয় হয়েছে ৫৪ লাখ স্মার্ট কার্ড। অর্থাৎ এই ৫৪ লাখ পরিবার বর্তমানে টিসিবির পণ্য কিনতে পারছেন। টিসিবির মোট এক কোটি পরিবারের কাছে স্মার্ট কার্ড সরবরাহের কথা রয়েছে।
সংস্থাটির উপরিচালক ও মুখপাত্র হুমায়ূন কবির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি কার্যক্রমে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। তবে এবার বাজার দরের সঙ্গে দাম সমন্বয়ের জন্য মসুর ডালের দাম ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। সামনে মসুর ডালের দাম কমলে তখন টিসিবি দাম কমাবে। ভবিষ্যতে টিসিবির কার্যক্রম আরও সম্প্রসারিত করা হবে। তখন বেশি মানুষ উপকৃত হবেন।
টিসিবির সংশ্লিষ্ট ডিলাররা জানিয়েছেন, রাজধানীর ৬০টি স্থানে পণ্য বিক্রি করছে টিসিবি। অতীতে কালশী, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী ও রামপুরায় সাধারণ মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়ে মারধরেরও শিকার হয়েছেন ট্রাকের কর্মীরা। রাজধানীর কালশীতে এক ট্রাকচালককে মেরে রক্তাক্ত করার ঘটনাও ঘটেছে।
মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) বেলা ১১টার কিছু পরে রাজধানীর মতিঝিলের বক চত্বরের সামনে টিসিবির তালিকাভুক্ত ডিলার প্রতিষ্ঠান আর্শি ট্রেডার্সের খোলা ট্রাকে সয়াবিন তেল, মসুর ডাল ও চিনি বিক্রি করেছে টিসিবি। এখানকার এসব পণ্য কেনার জন্য লাইনে অপেক্ষা করছিলেন বেশ কিছু মানুষ। এরা সবাই মোটামুটি সরকারি বেসরকারি দফতরে নিম্ন ও মধ্য পর্যায়ের পদে কর্মরত মনে হলো।
কমবেশি ২০/২২ জনের পেছনে অনেকটাই ফিটফাট পোশাক পরা একজনকে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মোবাইল ফোনে লাইনের ছবি তুলতে গেলে আপত্তি করেন সবাই। কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলেও আপত্তি করেন।
পরে নাম পরিচয় গোপন রাখা হবে বা ছবি তোলা হবে না- এমন আশ্বাস দিলে মোবারক হোসেন নামের (ছদ্মনাম) একজন জানান, তিনি রাজধানীতে স্ত্রী, দুই সন্তান ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে মুগদা এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন ২০২২ সাল থেকে। একটি বেসরকারি ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করেন। বেতন নির্দিষ্ট থাকলেও বাজারের পণ্যমূল্য নির্দিষ্ট নয়। বাড়ি ভাড়াসহ সন্তানের স্কুলের বেতন, তেল, সাবানের দাম বেড়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে অনেকটা কঠিন সময় কাটিয়ে উঠলেও এখন আর পারছেন না বলে জানান তিনি। চাল, ডাল, তেল পেঁয়াজসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যেরই দাম বেড়েছে। যা এখন তার অনেকটাই ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। তাই লাজলজ্জা ভুলে টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়েছেন কিছু টাকা বাঁচানোর জন্য।
টিসিবির পণ্যবাহী এই ট্রাকে দায়িত্বরত শ্রমিক তুহিন জানিয়েছেন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের সঙ্গে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেসে থাকা শিক্ষার্থীরাও এখন লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনতে আসছেন। এ সময় প্রায়ই তারা মাছ, মাংস ও তরকারি বিক্রির দাবি জানাচ্ছেন।
রাজধানীর কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থী মনির হোসেন বলেন, আমরা যারা মেসে থাকি, কমবেশি সবারই আর্থিক সমস্যা আছে। চাইলেই বাড়ি থেকে যখন-তখন টাকা আনতে পারি না। এ কারণে সবাই মিলে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সপ্তাহে একবার একজন টিসিবির লাইন থেকে বাজার করবো। সে অনুযায়ী আজকে আমার লাইনে দাঁড়ানোর পালা। তাই আজ আর ক্লাসে যাওয়া হয়নি। দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে প্রয়োজনীয় তিনটি পণ্য কিনলাম।
এদিকে বাংলাদেশ সচিবালয় এলাকায় টিসিবির লাইনে দাঁড়ানো গৃহিণী জাহানারা বেগম জানিয়েছেন, বাজারে তো সব পণ্যের দামই বেড়েছে, টিসিবি থেকে শুধু তিনটি পণ্য কেনা যায়। সয়াবিন তেল, মসুর ডাল আর চিনি। মাছ-মাংস বা কোনও তরকারি পাওয়া যায় না। কিন্তু এটা দরকার। বিষয়টি ভেবে দেখলে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত মানুষ আরেকটু ভালো থাকতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন জানিয়েছেন, বাজারে চাল ও আটা ময়দার দাম সংক্রান্ত বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত নয়। সে কারণে এসব পণ্যের দামের কথা বলতে পারবো না। তবে তেল, চিনি ও ডালের চাহিদা পূরণে সরকার সচেষ্ট রয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে টিসিবির কার্যক্রম আবার শুরু হয়েছে। এ কার্যক্রমের আওতায় বাজার দরের তুলনায় স্বল্পমূল্যে সয়াবিন তেল, মসুর ডাল ও চিনি বিক্রি চলছে। আগামীতে এর পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে। আশা করছি, বাজারে এর প্রভাব পড়বে, এতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবেন।