ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
Logo কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫ Logo চুলের রহস্য ফাঁস করলেন ক্যাটরিনা Logo গুমের ঘটনায় ভারতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেয়েছে কমিশন Logo ১২ ম্যাচে নবম হার ম্যানসিটির, আর্সেনালের বড় জয় Logo নারায়নগঞ্জ ক্লাবের নির্বাচনে সভাপতি পদে জয়ী হলেন- মোঃ সোলায়মান Logo ডোপ টেস্টে চালকসহ দুইজনের মদপানের সত্যতা মিলেছে Logo জিয়াউর রহমানকে ‘খুনি-রাজাকার’ বলায় যুবলীগ নেতার বাড়িতে হামলা Logo ৩০ ডিসেম্বর চুনকা পাঠাগারে আন্তর্জাতিক লেখক দিবস উদযাপন করবে বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব নারায়ণগঞ্জ Logo মদনগঞ্জ দারুস সালাম মাদরাসা’র বার্ষিক ফলাফল প্রকাশ, পুরস্কার বিতরণ ও দোয়ার অনুষ্ঠান Logo উত্তর ভারতের প্রেক্ষাগৃহ থেকে নামানো হচ্ছে ‘পুষ্পা-২’

আবারও মুখোমুখি জুবায়ের-সাদপন্থিরা

বিশ্বব্যাপী ইসলাম ধর্মের দাওয়াতি সংগঠন তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষ বাংলাদেশে আবারও মুখোমুখি অবস্থানে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা ঢাকায় মহাসমাবেশ করে দিল্লির মাওলানা সাদপন্থিদের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তারা ঘোষণা দিয়েছে, এবার মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশে আসতে দেওয়া হবে না। তাবলিগের বড় জমায়েত টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান জুবায়েরের অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এর পাল্টা জবাব দিতে আজ জাতীয় প্রেস ক্লাবে হাক্কানি ওলামা-মাশায়েখ পরিষদের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলনের ডাক দিয়েছে মাওলানা সাদের অনুসারীরা।

মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ওলামা-মাশায়েখ মহাসম্মেলন করেন কওমি মাদরাসার শীর্ষস্থানীয় আলেমরা। মূলত তারা তাবলিগের মাওলানা জুবায়েরের অনুসারী। তারা বলেছেন, কোনো অবস্থাতেই মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে আসতে দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া বিশ্ব ইজতেমার স্থান টঙ্গী ময়দান এবং তাবলিগ জামাতের মারকাজ (প্রধান কেন্দ্র) কাকরাইল মসজিদ হাক্কানি আলেমদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। হেফাজত ইসলামের আমির শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক খলিল আহমেদ কাসেমীসহ বিশিষ্ট আলেমরা সরকারের উদ্দেশে এসব কথা বলেন।

বিপুলসংখ্যক মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের উপস্থিতিতে সম্মেলনে ৯ দফা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক। তিনি আগামী ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি এবং ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই পর্বে ছয় দিন বিশ্ব ইজতেমার তারিখ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের যাবতীয় কার্যক্রম হাক্কানি আলেমদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। সেখানে সাদপন্থিদের কোনো কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হবে না।

ঘোষণাপত্রে কওমি মাদরাসার ওপর হয়রানি ও হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা, সাধারণ শিক্ষা সিলেবাসে ধর্মশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা, ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে নিরীহ ছাত্র-জনতা ও মুসল্লিদের ওপর নৃশংস গণহত্যার দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় এনে বিচার কার্যকর করার দাবি জানানো হয়। ঘোষণাপত্রে বলা হয়, স্বঘোষিত আমির মাওলানা সাদ কুরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যা, নবী-রাসুল ও সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আক্বিদা-বিশ্বাসবিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।

সম্মেলনে মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী সভাপতিত্ব করেন। তার লিখিত বক্তব্য পড়েন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী। তিনি বলেন, দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের বর্তমান মুরুব্বি মাওলানা সাদ বিভিন্ন সময় কুরআন-হাদিস, ইসলাম, নবী-রাসুল, নবুওয়াত, সাহাবায়ে কেরাম এবং শরিয়তের মাসআলা সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তার বক্তব্যগুলো কুরআন-সুন্নাহবিরোধী, যা মেনে নেওয়া যায় না। তার এসব আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য দারুল উলুম দেওবন্দসহ বিশ্ব আলেমদের কাছে তিনি চরম বিতর্কিত হয়েছেন। আলেমরা দায়িত্ব নিয়ে তাকে সংশোধন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।

সম্মেলনের প্রধান অতিথি হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক খলিল আহমাদ কাসেমী বলেন, এখন থেকে টঙ্গী ইজতেমা ওলামায়ে কেরামদের হাতে থাকবে, কাকরাইল মসজিদ ওলামায়ে কেরামদের তত্ত্বাবধানে থাকবে। হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজেদুর রহমান অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, আপনারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে, তাবলিগের ব্যাপারে আলেমদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

সমাবেশে মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজি সাদপন্থিদের ‘সাদিয়ানি’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘কাদিয়ানিরা ব্রিটিশের দালাল, আর সাদিয়ানিরা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর দালাল।

সম্মেলনে সারা দেশ থেকে আসা ৬৫ জন আলেম বক্তব্য রাখেন। সকাল ৯টায় আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন শুরু হলেও কার্যত ৭টা থেকে আলেমরা বক্তব্য রাখেন। এর আগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাজার হাজার মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক জড়ো হন। একপর্যায়ে উদ্যানে জায়গা না পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা, শাহবাগ মোড় থেকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত সড়ক, শাহবাগ মোড় থেকে টিএসসি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর পর্যন্ত সড়কে ছড়িয়ে পড়েন। দুপুর সোয়া ১টায় মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সম্মেলন শেষ হয়।

তাবলিগ জামাতের নেতৃত্ব নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে এর অনুসারীদের মধ্যে চরম বিভক্তি দেখা দেয়। এক পক্ষে বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়েরুল হক, অন্য পক্ষে মাওলানা সাদ। দুই পক্ষ টঙ্গীর ইজতেমা মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষেও লিপ্ত হয়। একপর্যায়ে ২০১৮ সাল থেকে দুই পক্ষ আলাদা ইজতেমার আয়োজন শুরু করে।

মাওলানা সাদ কান্ধলভিপন্থিদের মিডিয়া সমন্বয়ক আবু সায়েম সময়ের আলোকে বলেন, আমরা পাল্টাপাল্টি কিছু করতে চাই না। তারা মাদরাসা ছাত্রদের এনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাজনৈতিক দলের মতো শোডাউন করেছেন। সামনের নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে এবং মাদরাসার ছাত্রদের জড়ো করে তারা সরকারকে চাপে ফেলতে চাচ্ছে। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চাচ্ছে। তাবলিগের মোবারক মেহনতের সঙ্গে এ ছাত্ররা এখনও সম্পৃক্ত নয়। এই রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও নয়। যারা তাবলিগে সময় লাগান (চিল্লা) তাদের উপস্থিতি নেই; অথচ মাদরাসাগুলো থেকে ছোট ছোট বাচ্চা ছাত্রদেরও নিয়ে আসা হয়েছে। এটা মীমাংসিত বিষয়। দুই পক্ষ আলাদাভাবে ইজতেমা করে আসছে বিগত কয়েক বছর ধরে। ২০১৮ সালে ইজতেমা মাঠসহ বিভিন্ন জায়গায় জুবায়েরপন্থিদের হামলায় আমাদের সাতজন সাথি মারা গেছেন। সাদ সাহেব অবশ্যই আসবেন। আমরা বিস্তারিত আজকের সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরব। তিনি বলেন, আমাদের রোখ (সময়) আগামী ১৫ নভেম্বর থেকে শুরু। তখন আমরা কাকরাইলে যাব, ইনশাআল্লাহ।

সাদপন্থিদের সমন্বয়ক তৌহিদুল হক সোহেল সময়ের আলোকে বলেন, আমরা ঐক্যের জন্য আহ্বান জানিয়েছি। আমরা বসতে চেয়েছি; তারা রাজি হয়নি। আমরা উসকানি দিচ্ছি না। তাদের ইজতেমা তারা করবেন, আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু তারা যেসব কথা বলছেন, তা অযৌক্তিক। প্রমাণ করতে পারবে না মাওলানা সাদ কুরআন-হাদিসের বাইরে কিছু বলেছেন। আমরা সরকারের কাছে সমাধান চাই।
জুবায়েরপন্থি নেতা ও হেফাজতের নায়েবে আমির মুহিউদ্দিন রাব্বানী সময়ের আলোকে বলেন, সোহরাওয়ার্দীতে মহাসমাবেশ করে জুবায়েরপন্থিদের জনমত বুঝিয়ে দিয়েছি। সরকারও দেখেছে আমাদের সমর্থন। জনগণ সাদপন্থিদের পক্ষে নেই। তারা পারলে এমন একটি মহাসমাবেশ করে দেখাক। মাওলানা সাদের বিরোধিতার পেছনে যুক্তি তুলে ধরে জুবায়েরপন্থি এ নেতা বলেন, তাবলিগের নাম নিয়ে তারা সাধারণ মানুষকে ঈমানহারা করছে। সাদ সাহেব নিজে হাদিস-কুরআন পরিপন্থী বক্তব্য দিচ্ছেন। তার বিভিন্ন বক্তব্যে মহানবী (সা.) সম্পর্কে বিষোদগার করা হয়েছে। সাদপন্থিরা ভ্রান্ত আক্বিদায় বিশ্বাসী। তিনি এলে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। আলেম-ওলামাদের সঙ্গে গন্ডগোল বাধবে। দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এ জন্য আমরা সাদকে দেশে আসতে দেব না।

পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চাইলে জুবায়েরপন্থি নেতা ও ওলামা-মাশায়েখ বাংলাদেশের মিডিয়া সেল প্রধান মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী সময়ের আলোকে বলেন, আমরা প্রশাসনকে বিস্তারিত বলেছি। দেখি তারা কী পদক্ষেপ নেয়। বুধবার নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করব।
এ প্রসঙ্গে ইসলামি চিন্তাবিদ অধ্যাপক মোখতার আহমাদ সময়ের আলোকে বলেন, ইসলামে এমন বিদ্বেষ খুবই দুঃখজনক ঘটনা। ক্ষুদ্র ইস্যুতেই বিভাজন তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এখানে দুই পক্ষই দ্বীনি কাজ করছেন। উভয় পক্ষকে ছাড় দিয়ে এক টেবিলে আলোচনায় বসতে হবে। আলেম-ওলামদের কথা শোনা উচিত। পাকিস্তান ও ভারতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও এসব নিয়ে দ্বন্দ্ব সামনে আসছে না। সমাবেশ ডাক দিয়ে কেন আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে বলতে হবে; হুমকি-ধমকি দিতে হবে। এগুলো ইতিবাচক ভাষা নয়। আমার মতে, উদারতার অভাব আছে, শক্তিশালী কোনো উদ্যোগ নেই। সরকার ধর্মীয় ইস্যুতে সেফ জোনে থাকতে চায় বলে মনে হচ্ছে। দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে আমরাও ভাবছি। মুরুব্বিদের এক করার চেষ্টা করব।

মুহাদ্দিস ও ইসলামি লেখক মুফতি আরিফ খান সাদ মনে করেন, আসলে তাবলিগ জামাতের চলমান সমস্যা কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়, বরং এটা একটা আন্তঃদেশীয় সমস্যা। ২০১৬ সালে দিল্লিতে শূরা কমিটির অন্যতম সদস্য মাওলানা সাদ কান্ধলভি নিজেকে একক আমির দাবি করেন। তখন দিল্লি মারকাজে মুরুব্বি ও অনুসারীদের মধ্যে দুটো গ্রুপের সৃষ্টি হয়। এক গ্রুপ সম্মিলিত শূরা কমিটি মেনে চলতে আগ্রহী, আরেক গ্রুপ মাওলানা সাদ কন্ধলভিকে আমির মেনে চলতে আগ্রহী। কারণ মাওলানা সাদ হলেন তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভির প্রপৌত্র। মূলত দিল্লিতে সৃষ্ট এ দ্বন্দ্বটাই সংক্রমিত হয় পাকিস্তানে এবং বাংলাদেশে। ফলে তাবলিগ জামাতের এ সমস্যা দিল্লিতে সুরাহা না হলে বাংলাদেশেও সুরাহা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

এদিকে সোমবার তাবলিগের দুই পক্ষকে নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে সরকার। তবে এ আলোচনায় মাওলানা সাদ কান্ধলভির (দা.বা) অনুসারীরা অংশ নিলেও মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা অংশ নেননি। মন্ত্রণালয়ে বৈঠক শেষে তাবলিগের মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারী মাওলানা মুয়াজ বিন নূর বলেন, আমরা টানা সাত বছর তাবলিগের মাঠসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বঞ্চিত হচ্ছি। যারা আমাদের এতদিন বাধা দিয়ে আসছেন তাদের (মাওলানা মোহাম্মদ জুবায়েরের অনুসারী দল) মন্ত্রণালয় থেকে দাওয়াত দেওয়া হলেও তারা আসেনি। তারা বাংলাদেশে এ বৈষম্য সৃষ্টি করে রেখেছে। এই না আসার মধ্য দিয়ে তারা সরকারকে অবজ্ঞা করেছে। তারা বোঝাতে চেয়েছে তারা যা ইচ্ছা তাই করবে।ৃ

আপলোডকারীর তথ্য

Rudra Kantho24

জনপ্রিয় সংবাদ

কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫

আবারও মুখোমুখি জুবায়ের-সাদপন্থিরা

আপডেট সময় ১১:১৫:২৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৬ নভেম্বর ২০২৪

বিশ্বব্যাপী ইসলাম ধর্মের দাওয়াতি সংগঠন তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষ বাংলাদেশে আবারও মুখোমুখি অবস্থানে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা ঢাকায় মহাসমাবেশ করে দিল্লির মাওলানা সাদপন্থিদের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তারা ঘোষণা দিয়েছে, এবার মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশে আসতে দেওয়া হবে না। তাবলিগের বড় জমায়েত টঙ্গীর ইজতেমা ময়দান জুবায়েরের অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এর পাল্টা জবাব দিতে আজ জাতীয় প্রেস ক্লাবে হাক্কানি ওলামা-মাশায়েখ পরিষদের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলনের ডাক দিয়েছে মাওলানা সাদের অনুসারীরা।

মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ওলামা-মাশায়েখ মহাসম্মেলন করেন কওমি মাদরাসার শীর্ষস্থানীয় আলেমরা। মূলত তারা তাবলিগের মাওলানা জুবায়েরের অনুসারী। তারা বলেছেন, কোনো অবস্থাতেই মাওলানা সাদকে বাংলাদেশে আসতে দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া বিশ্ব ইজতেমার স্থান টঙ্গী ময়দান এবং তাবলিগ জামাতের মারকাজ (প্রধান কেন্দ্র) কাকরাইল মসজিদ হাক্কানি আলেমদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। হেফাজত ইসলামের আমির শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক খলিল আহমেদ কাসেমীসহ বিশিষ্ট আলেমরা সরকারের উদ্দেশে এসব কথা বলেন।

বিপুলসংখ্যক মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের উপস্থিতিতে সম্মেলনে ৯ দফা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক। তিনি আগামী ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি এবং ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই পর্বে ছয় দিন বিশ্ব ইজতেমার তারিখ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের যাবতীয় কার্যক্রম হাক্কানি আলেমদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। সেখানে সাদপন্থিদের কোনো কার্যক্রম চালাতে দেওয়া হবে না।

ঘোষণাপত্রে কওমি মাদরাসার ওপর হয়রানি ও হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা, সাধারণ শিক্ষা সিলেবাসে ধর্মশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা, ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে নিরীহ ছাত্র-জনতা ও মুসল্লিদের ওপর নৃশংস গণহত্যার দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় এনে বিচার কার্যকর করার দাবি জানানো হয়। ঘোষণাপত্রে বলা হয়, স্বঘোষিত আমির মাওলানা সাদ কুরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যা, নবী-রাসুল ও সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আক্বিদা-বিশ্বাসবিরোধী বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।

সম্মেলনে মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী সভাপতিত্ব করেন। তার লিখিত বক্তব্য পড়েন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী। তিনি বলেন, দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের বর্তমান মুরুব্বি মাওলানা সাদ বিভিন্ন সময় কুরআন-হাদিস, ইসলাম, নবী-রাসুল, নবুওয়াত, সাহাবায়ে কেরাম এবং শরিয়তের মাসআলা সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তার বক্তব্যগুলো কুরআন-সুন্নাহবিরোধী, যা মেনে নেওয়া যায় না। তার এসব আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য দারুল উলুম দেওবন্দসহ বিশ্ব আলেমদের কাছে তিনি চরম বিতর্কিত হয়েছেন। আলেমরা দায়িত্ব নিয়ে তাকে সংশোধন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন।

সম্মেলনের প্রধান অতিথি হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক খলিল আহমাদ কাসেমী বলেন, এখন থেকে টঙ্গী ইজতেমা ওলামায়ে কেরামদের হাতে থাকবে, কাকরাইল মসজিদ ওলামায়ে কেরামদের তত্ত্বাবধানে থাকবে। হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজেদুর রহমান অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, আপনারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করব। কিন্তু ধর্মের ব্যাপারে, তাবলিগের ব্যাপারে আলেমদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

সমাবেশে মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজি সাদপন্থিদের ‘সাদিয়ানি’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘কাদিয়ানিরা ব্রিটিশের দালাল, আর সাদিয়ানিরা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর দালাল।

সম্মেলনে সারা দেশ থেকে আসা ৬৫ জন আলেম বক্তব্য রাখেন। সকাল ৯টায় আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন শুরু হলেও কার্যত ৭টা থেকে আলেমরা বক্তব্য রাখেন। এর আগেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাজার হাজার মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক জড়ো হন। একপর্যায়ে উদ্যানে জায়গা না পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা, শাহবাগ মোড় থেকে মৎস্য ভবন পর্যন্ত সড়ক, শাহবাগ মোড় থেকে টিএসসি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর পর্যন্ত সড়কে ছড়িয়ে পড়েন। দুপুর সোয়া ১টায় মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সম্মেলন শেষ হয়।

তাবলিগ জামাতের নেতৃত্ব নিয়ে ২০১৮ সাল থেকে এর অনুসারীদের মধ্যে চরম বিভক্তি দেখা দেয়। এক পক্ষে বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়েরুল হক, অন্য পক্ষে মাওলানা সাদ। দুই পক্ষ টঙ্গীর ইজতেমা মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষেও লিপ্ত হয়। একপর্যায়ে ২০১৮ সাল থেকে দুই পক্ষ আলাদা ইজতেমার আয়োজন শুরু করে।

মাওলানা সাদ কান্ধলভিপন্থিদের মিডিয়া সমন্বয়ক আবু সায়েম সময়ের আলোকে বলেন, আমরা পাল্টাপাল্টি কিছু করতে চাই না। তারা মাদরাসা ছাত্রদের এনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাজনৈতিক দলের মতো শোডাউন করেছেন। সামনের নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে এবং মাদরাসার ছাত্রদের জড়ো করে তারা সরকারকে চাপে ফেলতে চাচ্ছে। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চাচ্ছে। তাবলিগের মোবারক মেহনতের সঙ্গে এ ছাত্ররা এখনও সম্পৃক্ত নয়। এই রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও নয়। যারা তাবলিগে সময় লাগান (চিল্লা) তাদের উপস্থিতি নেই; অথচ মাদরাসাগুলো থেকে ছোট ছোট বাচ্চা ছাত্রদেরও নিয়ে আসা হয়েছে। এটা মীমাংসিত বিষয়। দুই পক্ষ আলাদাভাবে ইজতেমা করে আসছে বিগত কয়েক বছর ধরে। ২০১৮ সালে ইজতেমা মাঠসহ বিভিন্ন জায়গায় জুবায়েরপন্থিদের হামলায় আমাদের সাতজন সাথি মারা গেছেন। সাদ সাহেব অবশ্যই আসবেন। আমরা বিস্তারিত আজকের সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরব। তিনি বলেন, আমাদের রোখ (সময়) আগামী ১৫ নভেম্বর থেকে শুরু। তখন আমরা কাকরাইলে যাব, ইনশাআল্লাহ।

সাদপন্থিদের সমন্বয়ক তৌহিদুল হক সোহেল সময়ের আলোকে বলেন, আমরা ঐক্যের জন্য আহ্বান জানিয়েছি। আমরা বসতে চেয়েছি; তারা রাজি হয়নি। আমরা উসকানি দিচ্ছি না। তাদের ইজতেমা তারা করবেন, আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু তারা যেসব কথা বলছেন, তা অযৌক্তিক। প্রমাণ করতে পারবে না মাওলানা সাদ কুরআন-হাদিসের বাইরে কিছু বলেছেন। আমরা সরকারের কাছে সমাধান চাই।
জুবায়েরপন্থি নেতা ও হেফাজতের নায়েবে আমির মুহিউদ্দিন রাব্বানী সময়ের আলোকে বলেন, সোহরাওয়ার্দীতে মহাসমাবেশ করে জুবায়েরপন্থিদের জনমত বুঝিয়ে দিয়েছি। সরকারও দেখেছে আমাদের সমর্থন। জনগণ সাদপন্থিদের পক্ষে নেই। তারা পারলে এমন একটি মহাসমাবেশ করে দেখাক। মাওলানা সাদের বিরোধিতার পেছনে যুক্তি তুলে ধরে জুবায়েরপন্থি এ নেতা বলেন, তাবলিগের নাম নিয়ে তারা সাধারণ মানুষকে ঈমানহারা করছে। সাদ সাহেব নিজে হাদিস-কুরআন পরিপন্থী বক্তব্য দিচ্ছেন। তার বিভিন্ন বক্তব্যে মহানবী (সা.) সম্পর্কে বিষোদগার করা হয়েছে। সাদপন্থিরা ভ্রান্ত আক্বিদায় বিশ্বাসী। তিনি এলে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। আলেম-ওলামাদের সঙ্গে গন্ডগোল বাধবে। দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এ জন্য আমরা সাদকে দেশে আসতে দেব না।

পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চাইলে জুবায়েরপন্থি নেতা ও ওলামা-মাশায়েখ বাংলাদেশের মিডিয়া সেল প্রধান মাওলানা ফজলুল করীম কাসেমী সময়ের আলোকে বলেন, আমরা প্রশাসনকে বিস্তারিত বলেছি। দেখি তারা কী পদক্ষেপ নেয়। বুধবার নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করব।
এ প্রসঙ্গে ইসলামি চিন্তাবিদ অধ্যাপক মোখতার আহমাদ সময়ের আলোকে বলেন, ইসলামে এমন বিদ্বেষ খুবই দুঃখজনক ঘটনা। ক্ষুদ্র ইস্যুতেই বিভাজন তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এখানে দুই পক্ষই দ্বীনি কাজ করছেন। উভয় পক্ষকে ছাড় দিয়ে এক টেবিলে আলোচনায় বসতে হবে। আলেম-ওলামদের কথা শোনা উচিত। পাকিস্তান ও ভারতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও এসব নিয়ে দ্বন্দ্ব সামনে আসছে না। সমাবেশ ডাক দিয়ে কেন আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে বলতে হবে; হুমকি-ধমকি দিতে হবে। এগুলো ইতিবাচক ভাষা নয়। আমার মতে, উদারতার অভাব আছে, শক্তিশালী কোনো উদ্যোগ নেই। সরকার ধর্মীয় ইস্যুতে সেফ জোনে থাকতে চায় বলে মনে হচ্ছে। দুই পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে আমরাও ভাবছি। মুরুব্বিদের এক করার চেষ্টা করব।

মুহাদ্দিস ও ইসলামি লেখক মুফতি আরিফ খান সাদ মনে করেন, আসলে তাবলিগ জামাতের চলমান সমস্যা কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়, বরং এটা একটা আন্তঃদেশীয় সমস্যা। ২০১৬ সালে দিল্লিতে শূরা কমিটির অন্যতম সদস্য মাওলানা সাদ কান্ধলভি নিজেকে একক আমির দাবি করেন। তখন দিল্লি মারকাজে মুরুব্বি ও অনুসারীদের মধ্যে দুটো গ্রুপের সৃষ্টি হয়। এক গ্রুপ সম্মিলিত শূরা কমিটি মেনে চলতে আগ্রহী, আরেক গ্রুপ মাওলানা সাদ কন্ধলভিকে আমির মেনে চলতে আগ্রহী। কারণ মাওলানা সাদ হলেন তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভির প্রপৌত্র। মূলত দিল্লিতে সৃষ্ট এ দ্বন্দ্বটাই সংক্রমিত হয় পাকিস্তানে এবং বাংলাদেশে। ফলে তাবলিগ জামাতের এ সমস্যা দিল্লিতে সুরাহা না হলে বাংলাদেশেও সুরাহা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

এদিকে সোমবার তাবলিগের দুই পক্ষকে নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে সরকার। তবে এ আলোচনায় মাওলানা সাদ কান্ধলভির (দা.বা) অনুসারীরা অংশ নিলেও মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা অংশ নেননি। মন্ত্রণালয়ে বৈঠক শেষে তাবলিগের মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারী মাওলানা মুয়াজ বিন নূর বলেন, আমরা টানা সাত বছর তাবলিগের মাঠসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বঞ্চিত হচ্ছি। যারা আমাদের এতদিন বাধা দিয়ে আসছেন তাদের (মাওলানা মোহাম্মদ জুবায়েরের অনুসারী দল) মন্ত্রণালয় থেকে দাওয়াত দেওয়া হলেও তারা আসেনি। তারা বাংলাদেশে এ বৈষম্য সৃষ্টি করে রেখেছে। এই না আসার মধ্য দিয়ে তারা সরকারকে অবজ্ঞা করেছে। তারা বোঝাতে চেয়েছে তারা যা ইচ্ছা তাই করবে।ৃ