রাষ্ট্রপতি অপসারণে সবদিক বিবেচনা করে সংবিধানের বাইরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। দলটি মনে করছে, বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর; সতর্ক অবস্থানে থেকে তারা বক্তব্য বিবৃতি দেবেন। রাষ্ট্রপতি অপসারণে সাংবিধানিক শূন্যতাকে জোর দেবেন। এমনকি এ ইস্যুতে অন্য দল ও ছাত্র সমন্বয়কদের হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাবে বিএনপি।
গত সোমবার রাতে এ নিয়ে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। আলোচনার কেন্দ্রে ছিল রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনের অপসারণ ইস্যু।
এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সময়ের আলোকে বলেন, আমরা নতুন করে কী বলবো। আমাদের অবস্থান তো আগেই পরিষ্কার করেছি। যৌক্তিক সাংবিধানিক ব্যাখ্যা দিয়েছি।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সময়ের আলোকে বলেন, এ নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আমরা আমাদের কথা বলেছি।
সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, আমরা যা আলোচনা করেছি তা মহাসচিব আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্য সময়ের আলোকে বলেন, দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। যে কোনো ইস্যু নিয়েই এখন বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে। এর পেছনে বড় একটি চক্র আছে। অপ্রয়োজনীয় কাজ করে সময় ক্ষেপণ করা হচ্ছে। সব ক্ষেত্রে ব্যক্তি দেখলে হবে না। প্রতিষ্ঠানকে গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন ফ্যাসিবাদের ‘প্রোডাক্ট’ হলেও তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বড় ধরনের সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে, যা নির্বাচনকে পিছিয়ে দিতে পারে। নতুন করে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট তৈরি করা যাবে না। বিএনপি সংবিধানের বাইরে যাবে না। এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি অপসারণ হলে জাতীয় সংকট দেখা দেবে।
বিএনপি নেতারা মনে করছেন, রাষ্ট্রপতির পদে হঠাৎ শূন্যতা সৃষ্টি হলে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথও বিলম্বিত হবে এবং নির্বাচন পিছিয়ে যাবে। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রে নতুন করে কোনো ধরনের সংকট বা জটিলতা তৈরি হলে বিএনপিই সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হবে।
সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রপতির অপসারণ ছাড়াও স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদারসহ আরও বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে কেউ কেউ রাষ্ট্র মেরামতে ঘোষিত সংস্কার কর্মসূচি এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবির বিষয়টি জোরালো করার আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সর্বশেষ অডিও কথোপকথনের বিষয়টিও বৈঠকে উঠে আসে। কেউ কেউ এসব নিয়ে হাস্যরস করেন। হাইকমান্ড সবাইকে সজাগ থাকার কথা বলেছেন।
আগামী নভেম্বর থেকে রাজধানীসহ জেলা ও মহানগরে নতুন করে গণসংযোগ কর্মসূচি শুরু করবে বিএনপি। রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি সামনে রেখে এই কর্মসূচি শুরু করছে দলটি। এসব কর্মসূচির মধ্যে ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ জাঁকজমকভাবে পালন করা হবে। এ উপলক্ষে ঢাকাসহ সারা দেশে জেলা ও মহানগরে ১০ দিনের কর্মসূচি থাকবে। ঢাকায় বড় আকারে শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভা হবে। ৭ নভেম্বর-কেন্দ্রিক কর্মসূচির পর অবস্থা বুঝে সাংগঠনিক কর্মসূচির গতি বাড়ানো-কমানো হবে।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় হঠাৎ বন্যার কারণে রাজনৈতিক কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছিল। এখন আবার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে জানা গেছে।
গত সোমবার রাতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে রাত ৯টা ১৫ মিনিটে এ বৈঠক শুরু হয়। আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বেগম সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ (বীর বিক্রম) ও ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।
গত সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে বিএনপি নেতারা জানিয়েছিলেন, এই মুহূর্তে কোনো সাংবিধানিক সংকট তৈরি হোক, সেটা তারা চান না। এরপর দৃশ্যপট পাল্টে যায় অনেকটা। রাতেই ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা রাষ্ট্রপতি অপসারণ ইস্যুতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন। ছাত্রনেতারা ও অন্তর্বর্তী সরকার এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে পিছিয়ে দেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসার কথা বলেন।
গত শুক্রবার জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ছাত্রনেতারা বৈঠক করেন। জামায়াত বলেছে, রাষ্ট্রপতি অপসারণে তারা নীতিগতভাবে একমত। কিন্তু এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য দরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের সঙ্গে সংলাপে ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল ও জোট একই মতামত দিয়েছে। অর্থাৎ বিএনপির মতামত যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটাও স্পষ্ট হয়েছে তাদের বক্তব্যে। দ্বিতীয় দফায় গত শনিবার ছাত্রনেতারা বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
বিএনপি বলেছে, তারা দলীয় ফোরামে আলোচনা করে জানাবে। গত রোববার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাষ্ট্রপতি অপসারণে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিএনপি নেতারা এ-ও বলছেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে কোনো বিরোধে জড়াবে না তারা। বরং দ্রুত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করবে। একের পর এক ইস্যু নতুন করে সামনে আসতে থাকলে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে।
এ বিষয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, রাষ্ট্রপতির বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল। আমরা প্রথমে এর সাংবিধানিক ব্যাখ্যা দিয়েছি। ছাত্ররা তাদের মতামত দিয়েছে। বিএনপি এটি নিয়ে আগের অবস্থানেই আছে।