মোঃ মামুন হোসেন: জীবন এক বিশাল ক্যানভাস—যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত তুলির ছোঁয়ায় আঁকা হয় নানা রঙে, নানা অনুভবে। কখনও তাতে থাকে সুখের উজ্জ্বল রং, কখনও বা বেদনার ঘন অন্ধকার। এই ক্যানভাসে কেউ আঁকে স্বপ্ন, কেউ সংগ্রাম, আবার কেউবা ভালোবাসার নিঃশব্দ ইতিহাস। জীবন শুধুই সময়ের প্রবাহ নয়—এটি এক বহুমাত্রিক চিত্রকলা, যার প্রতিটি রেখা, প্রতিটি রং একটি গল্প বলে, একটি অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
শৈশব—এই ক্যানভাসের শুরুটা হয় সবচেয়ে উজ্জ্বল রঙ দিয়ে। মায়ের কোলে প্রথম চিৎকার, বাবার হাত ধরে হাঁটার চেষ্টা, ভাইবোনের সাথে দুষ্টুমি—সব মিলিয়ে এক রঙিন, সরল জীবন। এই সময়ে আমরা পৃথিবীকে দেখি বিস্ময় নিয়ে, প্রতিটি জিনিস নতুন মনে হয়। খেলাধুলা, পড়াশোনা, পরিবারের ভালোবাসা—সবকিছু মিলিয়ে গড়ে ওঠে এক নির্ভেজাল আনন্দের জগত। এই শৈশব আমাদের ক্যানভাসে একধরনের নিষ্পাপ শুভ্রতা যুক্ত করে, যা পরবর্তী জীবনের জটিলতার মাঝে আমাদের প্রেরণা জোগায়। এরপর আসে কৈশোর—জীবনের এক উত্তাল অধ্যায়। এই পর্যায়ে জীবনের ক্যানভাসে যুক্ত হয় অনেক গাঢ় রঙ। আবেগ, কৌতূহল, আত্ম-অন্বেষণ—সব মিলে এটি হয়ে ওঠে সবচেয়ে গতিশীল সময়। বন্ধু, প্রেম, স্বপ্ন, দ্বিধা—সব মিলিয়ে এক নতুন জগতের সূচনা হয়। কৈশোরের ভুলভ্রান্তিগুলোও এই ক্যানভাসে একটা পরিপূর্ণতা এনে দেয়, কারণ এগুলো আমাদের শেখায়, গড়ে তোলে। ক্যানভাসে যদি কখনও কিছু আঁকাবাঁকা রেখা পড়ে, সেগুলোও পরে হয়ে ওঠে গভীর শিল্প। যৌবন—জীবনের সবচেয়ে শক্তিশালী রঙ ব্যবহার করা হয় এই পর্যায়ে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের দুরন্ত ছুটে চলা, ক্যারিয়ার গঠন, পরিবার গড়া, সমাজের নানা চাপে মানিয়ে চলার সংগ্রাম—এই সব কিছুই জীবনের ক্যানভাসে গভীর অর্থবহ রঙ এনে দেয়। এখানে প্রতিটি পদক্ষেপ এক একটি দাগ ফেলে, যা কখনো গর্বের, আবার কখনো অনুশোচনার। প্রেম ও দায়িত্ব একে অন্যের সাথে হাত মিলিয়ে পথ চলে—এই পর্বে জীবন আমাদের সবচেয়ে বাস্তব পাঠ দেয়।প্রৌঢ়ত্ব—যখন জীবন অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে শান্ত হয়ে আসে। ক্যানভাসের রঙ তখন কিছুটা পরিপক্ব, কিছুটা ম্লান, কিন্তু গভীরতায় পূর্ণ। সন্তানদের বড় করে তোলা, জীবনের নানা সাফল্য ও ব্যর্থতার পর্যালোচনা, অতীতের স্মৃতিচারণ—সব মিলিয়ে এই সময় এক ধরণের আত্মতৃপ্তি ও উপলব্ধির সময়। অনেকেই এই সময়ে জীবনের মানে খোঁজে, ধর্ম, আত্মশুদ্ধি বা সমাজসেবার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই রং কিছুটা ধূসর হলেও, তা ভীষণ শৈল্পিক এবং হৃদয়ছোঁয়া। বার্ধক্য—জীবনের ক্যানভাসের শেষ অংশ, যেখানে তুলির টান ধীরে আসে, কিন্তু প্রতিটি আঁচড় থাকে গভীরতায় ভরা। শরীরের শক্তি কমে এলেও স্মৃতির রং গাঢ় হয়ে ওঠে। পুরনো দিনের কাহিনী, অতীতের হাসি-কান্না—সবকিছু যেন বারবার ফিরে আসে মানসপটে। এই সময় জীবন ধীরে ধীরে এক নিস্তব্ধতার দিকে এগিয়ে যায়, কিন্তু ক্যানভাসে থেকে যায় এক অপূর্ব শিল্পকর্মের ছাপ। জীবনের এই ক্যানভাসে আমরা কেউ শিল্পী, কেউ দর্শক, আবার কেউ হয়ে যাই নিজের অজান্তেই একটি রঙ। কেউ আমাদের জীবনে এসে রঙ ছড়িয়ে দেয়, কেউ হয়তো তা মুছে দিয়ে যায়। তবু জীবন থেমে থাকে না—সে এগিয়ে চলে। কখনও অশ্রু, কখনও হাসি, কখনও হাহাকার, কখনও ভালোবাসা—সব মিলিয়ে জীবন এক পূর্ণাঙ্গ শিল্পকর্ম।এই ক্যানভাসকে সুন্দর করতে হলে প্রয়োজন কিছু জিনিসের—আত্মবিশ্বাস, ধৈর্য, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, সহানুভূতি এবং ভালোবাসা। যদি আমরা নিজেদের হৃদয়ের রঙ দিয়ে অন্যের জীবনে আলো ফেলতে পারি, তবে এই ক্যানভাস হবে আরও উজ্জ্বল, আরও অর্থবহ। জীবনের রং সবসময় উজ্জ্বল নয়, কিন্তু প্রতিটি রংই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, জীবনের অর্থ কেবল সাফল্যে নয়—ব্যর্থতাতেও, কেবল হাসিতে নয়—কান্নাতেও। তাই আমাদের উচিত জীবনের প্রতিটি রঙকেই গ্রহণ করা, ভালোবাসা, এবং তার মধ্য দিয়ে একটি পরিপূর্ণ শিল্প সৃষ্টি করা।শেষ পর্যন্ত এই ক্যানভাস হয়তো একটি সময়ে নিস্তব্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু তার রেখা, তার রঙ, তার গল্প থেকে যাবে অন্যদের মনে, অন্যদের জীবনে। আর এভাবেই জীবনের বর্ণিল ক্যানভাস হয়ে ওঠে চিরন্তন।
ঢাকা
,
সোমবার, ১১ অগাস্ট ২০২৫, ২৭ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :










জীবনের বর্ণিল ক্যানভাস
-
রুদ্রকন্ঠ ডেস্ক :
- আপডেট সময় ১০:০৬:৩৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১১ অগাস্ট ২০২৫
- 7
জনপ্রিয় সংবাদ